আমার থাকার ব্যবস্থা হলো মিজান ভাইয়ার ঘরে। এই ঘরে ফ্যান আছে। তিনি ফ্যান ছাড়েন না, কারণ ফ্যানের বাতাসে তার ঠাণ্ডা লাগে। বুকে কফ বসে যায়। ঘরে একটা জানালা আছে, সেই জানালা তিনি খুলেন না, কারণ জানালা দক্ষিণমুখী। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসে। এই হাওয়াতেও তার সমস্যা। সারারাত তিনি বিরামহীন কাশেন। এই কাশি দিনে থাকে না। রাতে ঘুমাতে যাবার পর থেকে তিনি কাশতে শুরু করেন। গল্পের প্রায় সবটাই বাংলা বানান বিষয়ে।
‘বাংলা একাডেমী এক ধরনের বানান শুরু করেছে। নতুন বানানরীতি। এই রীতিতে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের অনেক বানান ভুল। আফসোসের কথা কিনা তুমি বলো।’
উনি যা বলেন আমি তাতেই সায় দেই। আশ্রিত মানুষের সাধারণ প্রবণতা থেকে এই কাজটা করে। তাদের মাথায় থাকে সবাইকে খুশি রাখতে হবে।
স্যার, আপনার কি মনে হচ্ছে আমি জ্ঞানীর মতো কথা বলা শুরু করেছি। আমার মনে হয় হচ্ছে, কারণ আপনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। স্যার যদি অপরাধ না নেন তাহলে বলি। আমি কিন্তু ভালো পড়াশোনা করা ছেলে। আমাদের এলাকায় বিশাল বড় একটা পাঠাগার আছে। নাম ‘অশ্বিনী বাবু সাধারণ পাঠাগার’। অশ্বিনী বাবুর ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই দিয়ে পাঠাগার। বাংলাদেশের যেকোনো বড় পাবলিক লাইব্রেরির চেয়েও সেই পাঠাগারের বইয়ের সংখ্যা বেশি।
অশ্বিনী বাবু এক রাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে ইন্ডিয়া চলে যান। তার বাড়িঘর নিয়ে নানান ক্যাঁচাল শুরু হয়। তাঁর বই দিয়ে পাবলিক লাইব্রেরি করা হয়। বিএনপি আমলে সেই লাইব্রেরির নাম হয় ‘শহীদ জিয়া পাবলিক লাইব্রেরি’। আওয়ামী লীগ আমলে নাম বদলে হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাঠাগার’। আমার কাছে সবসময় অশ্বিনী বাবু পাঠাগার। আমি এক বছর এই পাঠাগার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলাম। আমার মাসিক বেতন ছিল একশ’ ত্রিশ টাকা। এই টাকাটা আমাকে নিজের পকেট থেকে দিতেন পৌরসভার চেয়ারম্যান জলিল সাহেব।
অশ্বিনী বাবুর পাঠাগারে কোনো গল্প উপন্যাসের বই ছিল না। একটু ভুল বললাম, চারটা গ্রন্থাবলি ছিল (রবীন্দ্রনাথ, মানিক, বিভূতি এবং তারাশঙ্কর)। বাকি সব বই এককথায় জ্ঞানের বই। ইতিহাস, দর্শন, তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্র, বিজ্ঞান। প্রথমে বইপড়া শুরু করেছিলাম সময় কাটানোর জন্যে, শেষে নেশার মতো হয়ে গেল। অনেক রাত পর্যন্ত বই না পড়ে ঘুমাতে পারতাম না। গোগ্রাসে ভাত খাওয়ার কথা জানি, তখন জানলাম গোগ্রাসে বইপড়া। আমার বইপড়া অভ্যাসটা একসময় খুব কাজে এলো।
কীভাবে সেটা বলি।
স্যার, আপনি মূল গল্পে আসতে বলেছেন। এই কথাগুলো না বলে মূল গল্পে আসা যাবে না। একটু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।
স্যার প্লিজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের একজন অধ্যাপক, ধরা যাক তার নাম প্রফেসর মোহিত হাওলাদার (নকল নাম দিলাম, আসল নাম দিতে চাচ্ছি না।) তাঁর একটা বই ছাপা হচ্ছিল আমাদের মিশন প্রেসে। বইয়ের নাম ‘কোয়ান্টাম জগৎ’। বইয়ের ফাইনাল প্রুফ আমি স্যারের ফুলার রোডের বাসায় নিয়ে যাই। প্রুফ ভেতরে পাঠিয়ে আমি স্যারের বসার ঘরের সোফার এক কোণায় বসে থাকি। স্যার আগের প্রুফ ফেরত পাঠান। কোনো কোনো দিন সঙ্গে সঙ্গেই প্রুফ পাই। আবার কখনো দুই তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। একদিনের কথা আমি অনেকক্ষণ বসে আছি। সকালবেলা গেছি, দুপুর হয়ে গেছে। স্যার আগের প্রুফ দিচ্ছেন না। আমি চলে যাব নাকি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব তাও বলছেন না। অন্যদিন এত দেরি হলে চা বিস্কিট আসে, আজ তাও আসছে না। এক সময় স্যার বসার ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, তুমি?
তুমি কখন এসেছ?
সকাল আটটায় এসেছি স্যার।
স্যার বললেন, আশ্চর্য কথা। একটা ত্রিশ বাজে, আমাকে তো কেউ বলেনি তুমি এসেছ। সরি এক্সট্রিমলি সরি। তোমার নাম কী?
আমি নাম বললাম। স্যার আমার পাশে বসতে বসতে বললেন, প্রুফ কে দেখে?
আমি বললাম, ফার্স্ট প্রুফ দেখেন আমাদের একজন প্রুফ রিডার। ওনার নাম মিজান। আমি সেকেন্ড প্রুফ দেখি।
তোমাদের প্রুফ রিডিং খুবই ভালো। প্রায় নির্ভুল। চা খাবে?
আমি বললাম, জি না স্যার।
দশটা মিনিট বসো, আমি প্রুফ এবং প্রিন্ট অর্ডার একসঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি।
স্যার দশ মিনিটের কথা বলে প্রায় আধঘণ্টা পরে প্রফ হাতে বসার ঘরে ঢুকে বললেন, এসো খেতে আস। এতবেলা না খেয়ে যাবে কেন? অস্বস্তিবোধ করার কোনো কারণ নেই। বাথরুম ঐদিকে। হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে খেতে বসো। আমিও তোমার সঙ্গে খাব। আমি একা থাকি, তুমি জানো তো?
জানি স্যার।
ব্যাচেলর বাড়ির খাওয়া ভালো কিছু থাকবে না। One item food. এটাই আমার পছন্দ। আমার ফিলোসফি–আমরা খাই বেঁচে থাকার জন্যে। সুখাদ্য খাওয়ার জন্যে বেঁচে থাকি না।
খাওয়ার টেবিলে দু’জন বসলাম। সত্যি সত্যি এক আইটেম খাওয়ার। খিচুড়ি জাতীয় বস্তু। প্রচুর সবজি দেয়া। মাংসও আছে।
স্যার বললেন, ক্যালোরি হিসাব করে রান্না। পুরো এক প্লেট খিচুড়িতে ক্যালোরি হবে দু’হাজার। চামচ দিয়ে যদি খাও তাহলে প্রতি চামচে সত্তর থেকে আশি ক্যালোরি।
খাওয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎ আমি স্যারকে একটা প্রশ্ন করে বসলাম। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন ‘ইলেকট্রন ঘুরছে আমরা বলে থাকি। ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনের অবস্থানটা কী? অবস্থান অজানা। অবস্থান তখনি জানা যাবে যখন একজন অবজারভার বা একজন পরিদর্শক ইলেকট্রন কোথায় আছে জানার চেষ্টা করবেন। তার আগে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগৎ পরিদর্শক বা অবজারভার নির্ভর জগৎ।’