জি স্যার।
আবার স্যার। মারব থাপ্পড়। বলো ‘জি বস’।
জি বস।
তারপরেও হেড স্যারের চিঠির অমর্যাদা আমি করি না। আমি যার নুন খাই তার গুণ গাই। কিছুদিন হেড স্যারের নুন খেয়েছি। তুমি এক কাজ করো, এক সপ্তাহ পরে আস, দেখি থাকার কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কি-না।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, এই এক সপ্তাহ কই থাকব?
তিনি রেগে গিয়ে বললেন, এই এক সপ্তাহ কই থাকবা সেটা তুমি জানো। আমার কথা শেষ, এখন বিদায় হও।
ঢাকা শহরে আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। হোটেলে থাকার মতো পয়সাও নাই। কী করব বুঝতে পারলাম না। প্রেসের সামনে একটা বেঞ্চি পাতা ছিল। সেই বেঞ্চিতে বসে রইলাম। দুপুরে কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট থেকে দুটা পরোটা আর বুটের ডাল কিনে খেলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার বেঞ্চিতে বসলাম। প্রেস রাত বারোটার সময় বন্ধ হলো। ভেবেছিলাম কেউ একজন বলবে রাতটা প্রেসের ভেতর কাটিয়ে দিতে। কেউ কিছু বলল না। তারা বেঞ্চ ভেতরে ঢুকিয়ে তালা মেরে চলে গেল। ঢাকা শহরে আমার প্রথম রাত কাটল মিশন প্রেসের সামনে হাঁটাহাঁটি করে। প্রেসের সামনে একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে বলে জায়গাটা আলো হয়ে আছে। হাতে কোনো বই থাকলে ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো বই পড়ে রাত কাটিয়ে দিতে পারতাম। সঙ্গে কোনো বই ছিল না।
পরদিন সকাল এগারোটার দিকে মোবারক উদ্দিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। অতি বিরক্ত গলায় বললেন, রাতে কোথায় ছিলা? শুনলাম প্রেসের সামনে হাঁটাহাঁটি করেছ?
আমি বললাম, জি বস।
প্রুফ রিডিং-এর কাজ জানো?
জি-না।
বানান জানলেই প্রুফ রিডিং-এর কাজ জানা হয়।
বানান জানো?
আমি বললাম, জানি বস।
মোবারক উদ্দিন বললেন, মিজান কই? এদিকে আস, এই ছেলে বানান জানে কি-না দেখ।
মিজান কাছে এসে দাঁড়ালেন। প্রায় তালগাছের মতো লম্বা একজন মানুষ। চেহারায় বিড়াল ভাব আছে। দেখে মনে হয় আল্লাহ তাকে বিড়াল বানাতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে মত পাল্টে লম্বা মানুষ বানিয়েছে। ভদ্রলোকের মুখভর্তি দাঁত। দাঁতগুলো ঝকঝক করছে। দেখেই মনে হয় তার দাঁত ধারালো। মিজান বললেন, ‘কি’ এবং ‘কী’ এই দুয়ের মধ্যে তফাৎ কী?
আমি বললাম, স্যার জানি না।
তিনি মনে হলো আমার উত্তর শুনে খুশি হলেন। তিনি আনন্দের হাসি হেসে বললেন, দুটাই প্রশ্নবোধক। যে ‘কি’র উত্তর মাথা নেড়ে দেয়া যায় সেটা হ্রস্বই কারে ‘কি’। যেমন ভাত খেয়েছ কি?
আবার যার উত্তরে কিছু বলতে হয় মাথা নেড়ে কাজ হয় না সেটা দীর্ঘইকারে কী। যেমন তোমার নাম কী? এই প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়লে হবে না। নাম বলতে হবে। কাজেই দীর্ঘইকার।
মোবারক উদ্দিন ধমক দিয়ে বললেন, মিজান!
বাংলার প্রফেসরি বন্ধ করো। তুমি প্রফেসর না।
ইন্টার ফেল পাবলিক। এই ছেলে পারবে কি পারবে না–সেটা বলো।
মিজান বললেন, ডিকশনারি দেখতে পারলে পারবে। শিখায়া পড়ায়া নিতে পারব। ডিকশনারি দেখতে না পারলে হবে না।
মোবারক উদ্দিন বললেন, ডিকশনারি দেখতে পারবে না এটা তুমি কী বললা বিলাইয়ের মতো। তোমার চেহারা যেমন বিলাইয়ের মতো, বুদ্ধি-শুদ্ধি বিলাইয়ের মতো। এই ছেলে মেট্রিকে রাজশাহী বোর্ডে থার্ড হয়েছে। ইন্টারে হয়েছে সাত নম্বর।
স্যার! গল্পের মধ্যে একটু মিথ্যা বলে ফেলেছি। আপনার কাছে ক্ষমা চাই। মোবারক উদ্দিন আমার এসএসসি এইচএসসি রেজাল্ট নিয়ে কিছু বলেন নাই। এটা আমি বানায়ে বলেছি।
আমি যে পড়াশোনায় ভালো এটা যেন আপনি জানেন সেই কারণে বলেছি। আপনার কাছে ক্ষমা চাই। মোবারক উদ্দিন যেটা বললেন সেটা হলো– তোমার চেহারা যেমন বিলাইয়ের মতো কথাবার্তাও বিলাইয়ের মতো। পরীক্ষা নিয়া দেখ ডিকশনারি দেখতে পারে কি-না।
আমি ডিকশনারি দেখা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। ঠিক হলো সেকেন্ড প্রুফ দেখব। ফার্স্ট প্রুফ এবং লাস্ট প্রুফ দেখবেন মিজান। ফর্মা প্রতি পাব কুড়ি টাকা। এখান থেকে আমার খাবারের খরচ কেটে বাকিটা দিয়ে দেয়া হবে। অন্য ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত থাকব মিশন প্রেসে।
মিজান সাহেব আমার দেখা প্রথম লেখক। তিনি সব ধরনের বই লেখেন। তার লেখা ‘ছোটদের ক্রিকেট’ যেমন আছে তেমনি আছে ‘ছোটদের বিশ্বকাপ ফুটবল’।
তিনি কয়েকটা সেক্সের বইও লিখেছেন। এই বইগুলো সবচে’ চালু। নিউজ প্রিন্টে দশ হাজার এডিশন ছাপা হয়। এজেন্টের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তার গদ্য ভালো। বানান নির্ভুল। তার লেখা ‘নষ্টা মেয়ের মধ্যরাতের নষ্টামী ও দুষ্টামী’ বইটির প্রথম কয়েক লাইন পড়লেই আপনি বুঝবেন। বইটা আমার সঙ্গে আছে। স্যার পড়ে শোনাই। কিছু যদি মনে না করেন।
তার নাম কমলা। গাত্রবর্ণ কমলার মতো। মুখমণ্ডল কমলার মতো গোলাকার। বক্ষদেশও কমলার মতোই সুডৌল এবং গোলাকার। তবে বক্ষদেশের বর্ণ কমলার মতো না। ঈষৎ গোলাপি। সে নিয়মিত স্তন যুগল গোলাপজলে ধৌত করে বলে সেখানে গোলাপের সুবাস পাওয়া যায়।
স্যার, আপনার কাছে অনেক ফাউল কথা বলে ফেলেছি। নিজগুণে ক্ষমা করবেন। মিজান সাহেবের কথা বলি, ওনার বয়স চল্লিশ। তিনি চিরকুমার। অতি ভদ্র এবং বিনয়ী। প্রেসের সবাই তাকে ডাকে ম্যাও মামা।
তিনি রাগ করেন না। আমি তাকে মিজান মামা বলে ডাকা শুরু করেছিলাম। তিনি বললেন, আমাকে ভাইয়া ডাকবে। মামা বা আংকেল ডাকার মতো বয়স আমার হয় নাই। আমার ক্রমিক আমাশা আছে। এই কারণে স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে বলে বয়স বেশি মনে হয়।