বাংলাদেশে মাদক গ্রহণের সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। হিরোইন আসক্তরা উঁচ দিয়ে শরীরে বিষ ঢোকাচ্ছে। একই সুই অন্যরাও ব্যবহার করছে। এইচআইভি ভাইরাস ছড়ানোর কী সুন্দর সুযোগ!
এই দেশের কিছু অসহায় মানুষ বেঁচে থাকেন শরীরের রক্ত বিক্রি করে। তাদের কারোর এইচআইভি পজিটিভ রক্ত যখন অন্য কাউকে দেয়া হবে তখন অবস্থাটা কী? অনেক উন্নত দেশেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। দূষিত রক্ত মিশে গেছে ব্লাড ব্যাংকের রক্তে।
সিলেটের এইডস রোগীর কাছে ফিরে যাই। আমি রোগীর আত্মীয় স্বজনকে ডেকে বুঝালাম যে এই রোগ অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগের মতো না। স্বাভাবিক মেলামেশায় এই রোগ ছড়াবে না। এইডস রোগী যে গ্রীসে পানি খাচ্ছে সেই গ্লাসে অন্য কেউ যদি পানি খায় তাতেও তার রোগ হবে না। আমার কথায় তেমন কাজ হলো বলে মনে হলো না। তারা রোগীর দিকে ঘৃণা এবং ভয় নিয়ে তাকিয়ে রইল।
পশু-পাখিদের মধ্যে কেউ যদি রোগগ্রস্থ হয় তখন অন্যরা তাদের ত্যাগ করে। রোগীকে মরতে হয় সঙ্গীবিহীন অবস্থায় একা একা। মানুষ তো পশুপাখি না। মানুষ রোগীকে দেখবে পরম আদরে এবং মমতায়। রোগকে ঘৃণা করা যায়, রোগীকে কেন?
আমি এইডস রোগী আব্দুল মজিদকে (আসল নাম না, নকল নাম) বললাম, ভাই আমি AIDS নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানাব। আপনি কি সেখানে কাজ করবেন?
আব্দুল মজিদ ক্লান্ত গলায় বলল, আমার লাভ কী? আমি তো মরেই যাব।
আমি বললাম, আপনার লাভ হলো, ডকুমেন্টারি দেখে বাংলাদেশের মানুষ সাবধান হবে। আব্দুল মজিদ রাজি হলেন। তবে শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারলেন না। আমি সিলেট থেকে ফিরে চিত্রনাট্য তৈরি করার পরপরই শুনলাম তিনি মারা গেছেন।
দৌলত শাহ্’র অদ্ভুত কাহিনী
লেখালেখির শুরুর দিকে প্রুফ দেখতে আমাকে বাংলাবাজার যেতে হত। প্রকাশকরা ভয়ংকর মিষ্টি স্বর ভাসা চা দিয়ে আমাকে এক কোণায় বসিয়ে দিতেন। প্রকাশকদের মধ্যে যারা দয়ালু তারা একবার জিজ্ঞেস করতেন, নাশত কিছু খাবেন? আনিয়ে দেব?
পেটে ক্ষুধা থাকলেও চক্ষু লজ্জায় কখনোই বলতে পারতাম না। নাশতা খাব। গলির মোড়ে গরম গরম সিঙ্গাড়া ভাজছে দুটা সিঙ্গাড়া খাব।
দৌলত শাহর অদ্ভুত কাহিনীর নায়ক আসলে আমি নিজে। দৌলত শাহ একজন প্রুফ রিডার। আমিও প্রুফ রিডার। তফাৎ একটাই আমি নিজের উপন্যাসের প্রুফ দেখি। দৌলত শাহ অবিবাহিত। আমিও তাই তখনো বিয়ে করি নি। কল্পনায় অতি রূপবতী তরুণীর ছবি। যার সঙ্গে জীবন-যাপন করব কিন্তু সেই রূপবতাঁকে পুরোপুরি চিনব না। সে থেকে যাবে অধরা।
এই ভৌতিক গল্পেও তাই হয়েছে। আমি গল্পটি লিখে আনন্দ পেয়েছি। আনন্দের প্রধান কারণ গল্প লিখতে গিয়ে পুরানো ঢাকার বাংলাবাজার এলাকায় ফিরে যেতে পেরেছিলাম। টাইম মেশিনে চড়ে নষ্টালজিক অতীত ভ্রমণ।
*
স্যার, আমার নাম দৌলত শাহ। এটা আমার আসল নাম না। আসল নাম ধন মিয়া। এসএসসি পরীক্ষার আগে নাম রেজিস্ট্রি করতে হয়। হেড স্যার আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, বাবা তোমার নামটা তো ভালো না। অনেক অঞ্চলে নেংটুকে বলে ‘ধন’। অর্থ ঠিক রেখে নামটা বদলে দেই?
আমি বললাম, জি আচ্ছা স্যার।
তিনি নামের শেষে শাহ্ টাইটেল দিয়ে দিলেন।
ছিলাম ধন মিয়া, হয়ে গেলাম দৌলত শাহ্। হেড স্যার আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাঁর বাড়িতে থেকেই আমি এসএসসি পাস করি। সায়েন্সে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। আমার বাড়িঘর ছিল না, থাকার জায়গা ছিল না। ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট বের হবার পর হেড স্যার বললেন, তুমি দুটা পরীক্ষাতেই ভালো রেজাল্ট করেছ। তোমাকে ইউনিভার্সিটিতে পড়াই এই সামর্থ্য আমার নাই। ঢাকার বাংলাবাজারে থাকেন এক লোককে আমি সামান্য চিনি। তাকে পত্র লিখে দেই। দেখ তিনি কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন কি-না। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা যদি করে দেন, একটা দুটা টিউশনি।
আমি বললাম, জি আচ্ছা স্যার।
হেড স্যার বললেন, দেখ কষ্ট করে লেখাপড়াটা শেষ করতে পার কি-না। বিদ্যাসাগর ল্যাম্পপোস্টের আলোয় লেখাপড়া করে বিদ্যার সাগর উপাধি পেয়েছেন। বুঝেছ?
আমি বললাম, জি স্যার।
নগদ একশ সত্তর টাকা, একটা টিনের ট্রাঙ্ক এবং একটা পাটের ব্যাগ নিয়ে ঢাকায় উপস্থিত হলাম।
মোবারক উদ্দিন সাহেবকে খুঁজে বের করে হেড স্যারের চিঠি তার হাতে দিলাম। মোবারক উদ্দিন একটা ছাপাখানার মালিক। ছাপাখানার নাম মিশন প্রেস। তাঁর প্রকাশনা সংস্থা আছে। সেখান থেকে ধর্মের বই এবং সেক্সের বই বের হয়। সেক্সের বইগুলো গোপনে বিক্রি হয়। সবচে’ বেশি বিক্রি হয় যে বই তার নাম ‘ভাবি-দেবরের কামলীলা’। বইয়ের ভেতরে অনেকগুলো খারাপ খারাপ ছবি আছে। স্যার, আপনি দেখেছেন কি-না জানি না। মনে হয় দেখেন নাই। এইসব বই ভদ্রসমাজের জন্য না।
মোবারক উদ্দিন মানুষটা ছোটখাটো কিন্তু হাতির মতো শরীর। সারাক্ষণ ঘামেন। তার গরম বেশি বলে গায়ে কাপড় রাখতে পারেন না। খালি গায়ে থাকেন। একটা গামছা জড়ানো থাকে। এই গামছায় একটু পর পর মুখ মোছেন। মোবারক উদ্দিন বললেন, তোমার নাম দৌলত শাহ্?
আমি বললাম, জি স্যার।
তিনি বললেন, আমাকে স্যার বলবা না। আমি মাস্টারও না, অফিসারও না। আমাকে বস ডাকবা।
জি আচ্ছা।
হেড মাস্টার সাব চিঠি দিয়ে আমাকে ফেলেছেন বিপদে। আমার বাড়িটা হোটেল না, এতিমখানাও না। বুঝেছ?