রাগের ঘটনা করিম জেনেছে অনেক দিন পর। তার শাশুড়ি না-কি বলেছিলেন, যমুনার জামাইটা বোকা কিসিমের।
এটা রাগ করার কোনো বিষয়? সে বোকা এটাতো সত্যি। শাশুড়ি আম্মা একটা সত্যি কথা বলছিলেন। এই নিয়ে কোন মেয়ে এত রাগ করে?
করিম ভেবেছিল তার ঘুম আসবে না। বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর গাঢ় ঘুম। ঘুম ভাঙল জেলখানার মাওলানা সাহেব যখন ডেকে তুললেন। তাকে গোসল দেয়া হবে। তওবা পড়ানো হবে। মাওলানা সাহেব জেলখানায় পরিষ্কার পায়জামা ফতুয়া নিয়ে এসেছেন। এই কাপড় পরেই তার যাত্রী। করিম বলল, মাওলানা সাহেব একটা প্রশ্ন ছিল।
বলেন কী প্রশ্ন?
বেহেশতে কি শিং মাছের ঝোল পাওয়া যাবে?
মাওলানা প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হলেন না। ফাঁসির আসামি তওবা পড়ানোর আগে অনেক উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে। মাওলানা বললেন, বেহেশতে মানুষ যে খানাই খেতে চাবে তাই দেয়া হবে। সেই খানার স্বাদ হবে পৃথিবীর খানার স্বাদের চেয়েও এক হাজার গুণ বেশি। বলেন সোবাহানাল্লাহ।
করিম বলল, সোবাহানাল্লাহ।
করিমকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দু’জন পুলিশ দুদিক থেকে তাকে ধরে রেখেছে। তার হাত পেছন দিকে বাধা। তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। করিম কোনো হৈচৈ করছে না। অনেকেই করে ছুটে পালিয়ে যেতে চায়। জেলার সাহেব তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছেন। করিম তার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার যে আমার ফাঁসি দিবে তার নামটা কী বলবেন।
কী হবে নাম জেনে।
কৌতূহল আর কিছু না।
তার নাম রমজান। রমজান মিয়া।
নামটা বলার জন্যে স্যার শুকরিয়া।
করিমের মনে পড়ল তার ফ্ল্যাট বাড়ির দারোয়ানের নামও রমজান মিয়া। অতি বিনয়ী। বিশাল শরীর সেই তুলনায় মাথাটা ছোট। কথা বলতো মাটির দিকে তাকিয়ে। হাতের বিড়ি অদ্ভুত কায়দায় লুকিয়ে ফেলত। সবার সঙ্গে দু’একটা কথা সে বলতই স্যার ভালো আছেন? কী বাজার করছেন? ইলিশ মাছ? দাম কত নিল? মাছ আর খাওয়া যাবে না। খানা খাদ্য দেশ থাইকা উইঠা যাবে। মাটি খায়া থাকতে হবে।
করিম ভেবে পেল না এত মানুষ থাকতে মৃত্যুর আগে আগে রমজান মিয়ার কথা তার মনে পড়ছে কেন?
কাঠের পাটাতনে করিমকে দাঁড়া করানো হয়েছে। মচমচ শব্দ হচ্ছে। শব্দটা অদ্ভুত লাগছে। কেন অদ্ভুত লাগছে এটাও সে বুঝতে পারছে না। করিমের মাথায় কালো টুপি পরিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে সে যমুনার রহস্য ভেদ করল।
দারোয়ান রমজান মিয়া সব সময় তার সঙ্গে অনেক কথা বলে কিন্তু যমুনার মৃত্যুর দিন সে পাগলের মতো ছুটে বের হচ্ছে, রমজান মিয়া গেট খুলে দিল একটা কথাও বলল না।
যমুনা বলছিল, এই শোন ফুলিকে আমি রাখব না। বিদায় করে দেব। ও প্রায়ই দারোয়ানটার সঙ্গে গল্প করতে চায়।
করিম বলেছিল, থাক না। রমজান মিয়াইতো দেশের বাড়ি থেকে মেয়েটাকে এনে দিয়েছে। তার আপনা লোক। ফুলি দারোয়ানের কাছ থেকে যখন ফিরে তখন তার গায়ে থাকে বিড়ির গন্ধ।
করিম যমুনার গায়ের উপর থেকে যখন চাদর সরিয়েছিল তখন কড়া বিড়ির গন্ধ পেয়েছিল। রমজানের হাতের বিড়ির গন্ধ লেগেছিল যমুনার গায়ে। কত সহজ সমাধান।
করিম বিড়ির গন্ধ আবার পাচ্ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে যমুনার চুলের মিষ্টি গন্ধটা মনে করতে। মৃত্যুর সময় যমুনার চুলের মায়াবী গন্ধটা একবার যদি মনে পড়ত! বিড়ির উৎকট গন্ধ সব এলোমেলো করে দিচ্ছে।
জেলার সাহেব হাতের ইশারায় ফাঁসি কার্যকর করার সিগনাল দিলেন।
জনৈক আব্দুল মজিদ
আমার তিন মেয়েরই তাদের লেখক বাবার লেখা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল। এদের একজন শীলা আহমেদ) ক্লাস ফাইভ সিক্সে পড়ার সময় বলতো- “সব লেখকদের লেখা স্কুলে পাঠ্য হয় বাবারটা কেন যে হয় না।”
‘জনৈক আব্দুল মজিদ’ লেখাটি ইন্টারমিডিয়েট বাংলা সিলেকশনে পাঠ্য হয়েছে। আমার তিন মেয়ের কাউকেই এই লেখা পড়তে হয় নি, কারণ তারা পড়াশোনা শেষ করে ফেলেছে।
তবে এই লেখাটা পাঠ্য না হলেই ভাল হত! বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে ফরমায়েসী এক তাড়াহুড়ার লেখা গল্প বলা বা গল্প নির্মাণের আনন্দ অনুপস্থিত, প্রবন্ধের মুক্ত যুক্তির প্রান্তরও নেই। কি আর করা।
*
প্রায় এক যুগ আগের কথা (১৯৯৪), আমেরিকার জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মানুষদের জন্যে একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করবে। বিষয় এইডস। জনসচেতনামূলক ছবি। ডকুমেন্টারি তৈরির দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। আমি গভীর জলে পড়লাম। এইডস বিষয়ে আমার জ্ঞান শূন্যের কাছাকাছি। শুধু জানি এটি একটি ভাইরাসঘটিত ব্যাধি। যে ভাইরাস থেকে রোগটা হয় তার নাম Human Immunodoficiency ভাইরাস। সংক্ষেপে HTv, ঘাতক ব্যাধি। ওষুধ আবিষ্কার হয় নি। এইডস হওয়া মানেই মৃত্যু।
শূন্যজ্ঞান নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরিতে হাত দেয়া যায় না। বিষয়টা ভালোমতো জানা দরকার। একজন AIDS-এর রোগীকে খুব কাছ থেকে দেখা দরকার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সিলেটের এক গ্রামে একজন এইডস রোগীর দেখা সন্ধান পাওয়া গেল। ধরা যাক তার নাম আব্দুল মজিদ। সে কাজ করত ইন্দোনেশিয়ায়। ঘাতক ব্যাধি সে বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা বিরাট হৈচৈ শুরু করল, আব্দুল মজিদের এইডস হয় নি। সবই দুষ্ট লোকের রটনা। আব্দুল মজিদ নেক ব্যক্তি। আদর্শ জীবন যাপন করেন– ইত্যাদি।