জি না জনাব।
আপনি কি পালিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন?
জি না জনাব।
তাহলে ময়মনসিংহের টিকিট কেন কেটেছিলেন? রিলাক্স করতে যাবার জন্য?
উকিল সাহেবের কথায় করিম আহত হয়েছে কিন্তু রাগ করে নি। মনে কষ্ট পায় নি। উনি উনার কাজ করবেন। অপরাধী ধরবেন। তার যেন কঠিন শাস্তি হয় সেই ব্যবস্থা করবেন। এই কারণেই তাকে টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে। করিম মনে কষ্ট পেয়েছে জাহেদার কথায়। মেয়েটারে এত স্নেহ করতেন। মা ডাকতেন। এই নিয়ে যমুনা রাগ করতো।
কাজের মেয়েকে মা ডাকো কেন? নাম ধরে ডাকো। বেশি আদর করলে এরা মাথায় উঠে।
বাচ্চা মেয়ে, কত কাজ করে। মেয়েটাকে স্নেহ করি।
সেই মেয়ে এজলাসে উঠে এটা কী করল! লজ্জায় করিমের মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা।
তুমি উনাকে চেন?
চিনি।
উনার নাম বলো।
আব্দুল করিম।
উনার বাসায় তুমি কত দিন ধরে আছ?
এক বছর।
তোমাকে নিয়ে উনাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হতো?
হুঁ।
হুঁ না। পরিষ্কার করে বলো। প্রায়ই ঝগড়া হতো?
জি হইত।
উনার স্ত্রী সন্দেহ করতো যে উনার সঙ্গে তোমার খারাপ সম্পর্ক আছে?
হুঁ।
করিমের উকিল এই পর্যায়ে বললেন, জেরা ঠিক হচ্ছে না। সাক্ষীর মুখে তুলে দেয়া হচ্ছে।
তার উত্তর উকিল সাহেব বললেন, কিছু কিছু কথা মুখে তুলে দিতে হবে। বাচ্চা একটা মেয়ে নিজ থেকে গড়গড় করে নোংরা কথা বলতে পারে না।
করিমের মুখ ইচ্ছা করছিল মেয়েটাকে বলে, মাগো এই মিথ্যা কথাগুলো তুমি কেন বলছ? জিজ্ঞাস করা হয় নি। লজ্জাতেই জিজ্ঞাস করতে পারে নি। মেয়েটার মিথ্যা বলার একটা কারণ করিম অনেক পরে বের করেছে। মেয়েটার ধারণা করিম যমুনাকে খুন করেছে। মেয়েটা চাচ্ছে করিমের কঠিন শাস্তি হোক।
রাত নটা। জেলার সাহেবের বাসা থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার এসেছে। করিম যা যা বলেছে সবই এসেছে। করিম আগ্রহ করে খেতে বসল। আলুভাজি, ডিওয়ালা শিং মাছ তার পছন্দের খাবার তা কিন্তু না। যমুনার পছন্দের খাবার। সে তাকে বলেছে বেহেশতে সে আল্লাহ পাকের কাছে এই খাবারই দুই বেলা খেতে চাইবে।
করিম বলেছিল, বেহেশতে তুমি আলুভাজি পেতে পার, শিং মাছের ঝোল পাবে না।
যমুনা বলল, কেন পাব না?
করিম বলল, শিং মাছের প্রাণ আছে। শিং মাছের ঝোল রাঁধতে হলে শিং মাছের প্রাণ নষ্ট করতে হবে। বেহেশতের মতো জায়গায় কোনো প্রাণ নষ্ট করা যাবে না।
তোমাকে কে বলেছে?
কেউ বলে নাই। আমি চিন্তা করে বের করেছি।
যমুনা মুগ্ধ গলায় বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমার কথা ঠিক। কাজেই শিং মাছ যা খাবার আমি দুনিয়াতেই খেয়ে যাব। সপ্তাহে
একদিন অবশ্যই আমার জন্য শিং মাছ কিনে আনবে।
.
গার্ড জর্দা দিয়ে পান নিয়ে এসেছে। পানটা খেতে করিমের খুবই ভালো লাগল। সে নিজেই একটা সিগারেট ধরালো, গার্ডকে একটা দিল। গার্ড বলল, ভাই সাহেব মনে সাহস রাখবেন।
করিম বলল, রাখব। সাহস রাখার চেষ্টা করব। পারব কিনা জানি না। আচ্ছা ভাই আমাকে যে ফাঁসি দিবে তার নাম কী?
গার্ড বলল, দুই ভাই আছে। যাবজ্জীবন হয়েছে। তারাই ফাঁসি দেয়। এক ভাইয়ের নাম রমজান। আরেক ভাইয়ের নাম আলী। দুই ভাই-ই এখানে আছে। কে ফাঁসি দিবে জানি না।
কে ফাঁসি দিবে জানলে ভালো হতো।
কেন?
একজন নিরপরাধ মানুষের ফাঁসি দেয়ার কারণে তার কিছু পাপ হবে। সেই পাপ যেন না হয় তার জন্যে দোয়া করা দরকার। সে তো আর জানে না আমি নির্দোষ।
গার্ড বলল, ফাঁসির সব আসামি বলে সে নির্দোষ। যখন ফাঁসি দেবার জন্যে কালো টুপি দিয়ে তার মুখ ঢেকে দেয় তখনি সে বুঝে যে নির্দোষ না। অনেকেই চিৎকার করে বলে আমি দোষ করেছি আল্লাহপাক ক্ষমা করো। আপনি কি আরেকটা পান খাবেন, এনে দিব?
দেন, আপনার অনেক মেহেরবানি।
কোরান মজিদ পড়বেন?
আরবি পড়তে পারি না।
সিগারেট আছে, আর লাগবে না। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাসও আমার নাই। জেলার সাহেব দিয়েছেন বলে খাচ্ছি।
দ্বিতীয় পানে জর্দা বেশি ছিল। খাওয়ার পর করিমের মাথা ঘুরাতে লাগলো। কাঁচা সুপারির পান খেয়ে যমুনার একবার এরকম হল। মাথা ঘুরে বিছানায় পড়ে গেল। ঘামে শরীর গেল ভিজে। যমুনা বলল, এই শোন আমি মারা যাচ্ছি। তুমি আমার হাত ধরে বসে থাকো। তুমি নড়বা না। খবরদার নড়বা না। আহারে কী ছেলেমানুষী! মানুষ কি এত সহজে মরে? মানুষের মৃত্যু কঠিন ব্যাপার। অনেক আয়োজন লাগে। ভোরবেলায় তার মৃত্যু হবে। অনেক আয়োজন লাগবে, অনেক চিন্তার বিষয়ও আছে।
করিম রাত এগারোটার দিকে কম্বলে ঘুমাতে গেল। সে জানে ঘুম আসবে না। তার পরেও সময়টাতো পার করতে হবে। যমুনার কথা চিন্তা করলে সময়টা সুন্দর পার হয়ে যাবে। চিন্তা করার কত কিছু আছে। কত ঘটনা। একবার সে যমুনাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে, হঠাৎ শোনে রাগ করে সে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কী কারণে রাগ করেছে তা জানা যাচ্ছে না। দুপুরে সে কিছু খেল না। রাতেও না। যমুনার মা শুরু করলেন কান্না। এতদিন পরে মেয়ে এসেছে। খাওয়া-দাওয়ার কত আয়োজন অথচ মেয়ে উপোস। তিনি বারবার বলছেন, মারে আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। মানুষ ভুল করে না? তামাশা করে একটা কথা বললাম। মাফ করে দে মা।
যমুনা ঘাড় শক্ত করে বলল, মাফ করব না। কাল সকালে আমি চলে যাব। লোকজনের অনুরোধ, চোখের পানি কিছুই কাজ করল না।