মান্না মিয়ার বাকি গল্প অতি সরল। তিনি থাকতেন মসজিদে। দিনরাত নামায কালাম পড়তেন। মসজিদের পাশে অতি টক (প্রায় বিষাক্ত) এক বড়ুই গাছের নিচে বসে তসবি টানতেন। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভোরবেলায় তার কাছে কোরআন পাঠ শিখত। একেক দিন একেক জনের বাড়ি থেকে তার খাবার আসত।
মান্না মিয়া অজ্ঞাত পাপের সন্ধানেই তার বেশির ভাগ সময় ব্যয় করতেন। একসময় তাঁর মনে হলো ইসলাম ধর্মে বৈরাগ্যের স্থান নেই, অথচ তিনি চিরকুমার। এই অপরাধই হয়তো তাঁর অপরাধ। তখন তিনি হঠাৎ করেই বিয়ে করার জন্য ব্যস্ত হলেন।
একবার তাঁর মনে হলো তিনি শিশুদের তেমন পছন্দ করেন না, অথচ নবী করিম (সঃ) শিশুদের খুবই পছন্দ করতেন, এটাই হয়তো তার অপরাধ। তিনি হঠাৎ শিশুদের জন্য ব্যস্ত হলেন। বাড়িতে বাড়িতে শিশুদের সন্ধানে যাওয়া, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া তার দৈনিক রুটিন হয়ে দাঁড়াল।
ছয় বছর এইভাবে কেটে গেল। সপ্তম বর্ষের শুরুতে আমাদের গ্রামের মানুষেরা চাদা তুলতে শুরু করল। তারা মান্না মিয়াকে হজ্বে পাঠাবে। বেচারীর জীবনের একটা মাত্র শখ পূরণ করা হবে। আমাদের গ্রাম হতদরিদ্র, তারপরেও এক বছরের মধ্যেই টাকা উঠে গেল। ঠিক করা হলো গ্রামের একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি মান্না মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বোম্বাই পর্যন্ত যাবেন। জাহাজে তুলে দিয়ে ফিরে আসবেন।
মান্না মিয়া সেবারও যেতে পারলেন না। যাবার দুদিন আগে কঠিন অসুখে পড়ে গেলেন। মান্না মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আল্লাহ পাক আমার অপরাধ এখনো ক্ষমা করেন নি।
তারপরের বছর বর্ষাকালে মান্না মিয়া মারা যান। মৃত্যুর আগে আগে তিনি খুবই আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন আল্লাহপাক তার হজ্ব কবুল করেছেন। এখন তার গ্রামে ফিরতে আর বাধা নেই। নামের আগে হাজি লিখতেও সমস্যা নেই।
মান্না মিয়ার শবদেহ তার গ্রামের বাড়ি ভাটিপাড়ায় (সুনামগঞ্জ) পৌঁছে দেয়া হয়। অঞ্চলের মানুষ গভীর শ্রদ্ধায় শবদেহ গ্রহণ করে। তাকে কবর দেয়া হয় স্থানীয় মসজিদের পাশে।
হাজি মান্না মিয়ার গল্প শেষ হলো। আমার নিজের কথা শেষ হয়নি। আমার ভেতর অনেক ধরনের প্রশ্ন। স্বপ্নকে আমরা কতটুকু গুরুত্ব দেব। স্বপ্ন মানেই তো ইচ্ছাপূরণ। না-কি ইচ্ছাপূরণের বাইরেও কিছু আছে?
মান্না মিয়া বড় ধরনের কোনো অপরাধ কি সত্যিই করেছিলেন? যে মানুষ কখনো কোনো অপরাধ করে নি সে নিজেকে মহাঅপরাধী ভাববে এত বোকা তো মানুষ না। মান্না মিয়া যে অপরাধটা করেছিলেন সেটা তাহলে কী? সাধু মানুষ কখনো পালায় না, অপরাধীরাই পালিয়ে বেড়ায়। মান্না মিয়াও নিজ অঞ্চলে না গিয়ে আমাদের অঞ্চলেই পালিয়ে এসেছিলেন।
তারপরেও কিছু সমস্যা থেকেও যায়, যেমন বড়ুই গাছ বিষয়ক জটিলতা। গল্পে একটি বড়ুই গাছের কথা উল্লেখ করেছি। যে গাছের কডুইয়ের স্বাদ তিতা। মুখে দিলে থু করে ফেলে দিতে হয়। মান্না মিয়া যে গাছের নিচে বসে সারাদিন তসবি টানতেন। তার মৃত্যুর পর পর গাছের বড়ুইয়ের গুণগত পরিবর্তন হয়। বড়ুই হয়ে যায় মধুর মতো মিষ্টি। সেই বড়ুই আমি নিজেও খেয়ে দেখেছি। তবে এরও নিশ্চয়ই কোনো ব্যাখ্যা আছে। কিংবা ব্যাখ্যা নেই। আমরা ব্যাখ্যা এবং ব্যাখ্যাহীন এক জগতে বাস করে হিসাব মিলাতে চাই। কোনো হিসাবই কখনো মিলে না।
হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার
আয়োজন করে গল্প লিখতে বসেছি। এক বৈঠকে গল্প শেষ করব এই কারণেই আয়োজন। বল পয়েন্টের প্যাকেট, কাগজ, চায়ের কাপ, সিগারেটের প্যাকেট হাতের কাছে। বল পয়েন্টের প্যাকেট নিয়ে বসেছি কারণ কলমগুলো এমন যে সামান্য লিখলেই কালি আটকে আসে। আমার স্বভাব যে কলমে একবার কালি আটকালে সে কলম দূরে ছুঁড়ে ফেলা। লেখার কাগজের ব্যাপারেও আমার কিছু সৌখিনতা আছে। খুব দামী কাগজে লিখতে পছন্দ করি। যখন হত দরিদ্র অবস্থা ছিল তখনো রেডিও বণ্ড নামের কাগজ ব্যবহার করতাম। অমৃত ধারণ করতে হয় স্বর্ণভাণ্ডে, মাটির হাঁড়িতে না। লেখা আমার কাছে ‘অমৃতসম’।
এক বৈঠকে লেখা শেষ করতে হবে। কারণ সন্ধ্যাবেলা লেখা নিতে পত্রিকার অফিস থেকে লোক আসবে। আজই শেষ দিন। ঈদ সংখ্যায় আমার গল্প যাচ্ছে এ রকম বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে।
আয়োজন করে বসার কারণেই দুপুর পর্যন্ত একটা লাইন লেখা হল না! অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম– মাথায় কোনো গল্প নেই। গল্প দূরের কথা কোনো চরিত্র পর্যন্ত নেই। চারটা পাতা নষ্ট করেছি প্রতিটিতে একটা শব্দ লেখা “আম’। এত কিছু থাকতে আম কেন লিখেছি তাও বুঝতে পারছি না। রাজশাহী থেকে আমার কাছে একজন এক ঝুড়ি আম পাঠিয়েছে এটাই কি কারণ?
দুপুরে ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে কি মাথায় গল্প আসবে? আসতেও পারে। তাই করলাম। খেয়ে দেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম। ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যার পর। জেগে উঠে শুনি গল্প নেবার জন্যে লোক এসেছে। তাকে বসিয়ে রেখেই লেখা শুরু করলাম। ‘আম’-কে করলাম আমরা। প্রথম বাক্য–“আমরা পাঠকদের কথা দিয়েছিলাম ঈদ সংখ্যায়…”
লেখা যা দাঁড়াল তাকে আর যাই বলা যাক গল্প নিশ্চয়ই বলা যাবে না তবে ঈদ সংখ্যা যুগান্তরে গল্প হিসেবেই ছাপা হয়েছে। পাঠকরা চমকে উঠবেন কুড়ি বছর আগে আমি একটি কবিতার বইয়ের সমালোচনা লিখে সাপ্তাহিক রোববারে পাঠিয়েছিলাম। সেখানেও সমালোচনাটা ছাপা হয়েছে গল্প হিসেবে।