আমার কাছ থেকে হাজি মান্না মিয়ার এই গল্প শুনে বাবা খুব রাগ করলেন। তিনি কঠিন গলায় বললেন, হাজি সাহেবকে নিয়ে কখনো যেন এ ধরনের কথা বলা না হয়। উনি আমার শিক্ষক। আমি উনার কাছ থেকে কোরআন পাঠ শিখেছি। উনার মতো সুফি মানুষ আমি আমার জীবনে দেখি নি।
বাবা নিষেধ করেছেন বলেই হাজি মান্না মিয়ার গল্প বন্ধ হবে তা-না। যতবারই গ্রামের বাড়িতে যাই বড়চাচা কোনো না কোনো গল্প ফাঁদেন। একবার শুনলাম তার বিয়ের গল্প। সত্তর বছরে তার নাকি বিয়ের শখ হলো। কোনো বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেলে উঁকি ঝুঁকি মেরে বাড়িতে সেয়ানা মেয়ে আছে কি-না দেখার চেষ্টা করেন। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে পান মুখে দিতে দিতে বলেন– বাড়িতে কি বিবাহযোগ্য কোনো মেয়ে আছে? বাড়ির লোকজন বলত, পাত্র কে? হাজি মান্না মিয়া বলতেন, আমিই পাত্র।
হাজি মান্না মিয়ার বিবাহ সংক্রান্ত গল্প যখন বাবার কানে তোলা হলো (আমিই তুললাম) তখন বাবা বললেন, ঘটনা সত্যি কিন্তু অর্ধেক সত্যি। হাজি মান্না মিয়াকে বুঝতে হলে পুরো গল্প শুনতে হবে। হাফ টুথ মিথ্যার চেয়েও খারাপ।
বাবার কাছ থেকে হাজি মান্না মিয়ার পুরো গল্প আমি শুনেছি। এক বৈঠকে শুনতে পেলে ভালো হতো, সেটা সম্ভব হয় নি, ভেঙে ভেঙে শুনেছি। আজ হাজি মান্না মিয়ার গল্প বাবার মতো করেই বলার চেষ্টা করছি। পাঠকেরা পছন্দ করবেন কি-না জানি না। পাঠকেরা জটিল গল্প পছন্দ করেন। হাজি মান্না মিয়া জটিলতা বিহীন মানুষ। তাঁকে নিয়ে জটিল গল্প ফাদা সম্ভব না।
ইংরেজি উনিশশ তিরিশ সনের এক চৈত্র মাসের সন্ধ্যায় মান্না মিয়া বগলে একটা কম্বল এবং হাতে চটের বিশাল ব্যাগ নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে (কুতুবপুর, নেত্রকোনা) উপস্থিত হলো। তাঁর বয়স ষাটের উপর। মুখভর্তি সাদা দাড়ি। মাথায় বেতের টুপি। শক্ত সমর্থ চেহারা। তিনি অতি বিনয়ের সঙ্গে গ্রামের মসজিদে রাত কাটাবার প্রস্তাব দিলেন। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা তিনিই করবেন। তাঁর শুধু থাকার সমস্যা।
মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন, আজ রাতটা থাকবেন? মসজিদে থাকার দরকার কী? আমার বাড়িতে থাকেন।
মান্না মিয়া বললেন, আপনার দরবারে হাজার শুকরিয়া। আমি শুধু আজ রাতটা থাকব না। বাকি জীবন থাকব। আমি বিরাট একটা পাপ করেছি। এই জন্যে প্রতিজ্ঞা করেছি বাকি জীবন মসজিদে থাকব। পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব।
ইমাম সাহেব বললেন, কী পাপ করেছেন?
মান্না মিয়া বিচলিত গলায় বললেন, কী পাপ করেছি এটা আমি জানি না। আল্লাহপাক জানেন। তিনি সর্বজ্ঞানী।
কী পাপ করেছেন আপনি জানেন না?
জি-না জনাব।
আপনার দেশ কোথায়? আপনি কোত্থেকে এসেছেন?
সেইটাও জনাব আমি আপনাদের বলব না।
বলবেন না কেন?
আমার বলতে ইচ্ছা করে না এইজন্য বলব না। যদি কোনোদিন বলতে ইচ্ছা করে তখন বলব। আপনারা যদি আমাকে থাকতে দেন তাহলে থাকব। যদি না দেন অন্য কোনো জায়গার অনুসন্ধান করব।
আপনি কি অনেক জায়গায় গিয়েছেন?
জি জনাব। কেউ রাজি হয় নাই।
মসজিদের ইমাম সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, ঠিক আছে আজকের রাতটা থাকুন। আমি গ্রামের মুরব্বিদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে দেখি কী করা যায়।
মান্না মিয়া বললেন, জনাব বহুত শুকরিয়া।
মান্না মিয়া গ্রামের মসজিদে স্থায়ী হয়ে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সবাই তার গল্প জেনে গেল। জটিল কোনো গল্প না। খুবই সরল গল্প। মান্না মিয়ার বাড়ি ভাটি অঞ্চলে। ঠিক কোন জায়গা সেটা তিনি কোনোদিনই বলেন নি। একরাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন হজ্ব করছেন। কাবা শরীফের চারপাশে ঘুরছেন। স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙে গেল, তিনি খুবই অস্থির বোধ করলেন। কারণ তিনি হতদরিদ্র মানুষ। হজ্বে কীভাবে যাবেন? খরচ পাবেন কোথায়?
তার গ্রামের মানুষরা তার স্বপ্নের কথা শুনল এবং তারাই চাঁদা তুলে হজ্বে যাবার খরচ সংগ্রহ করল। তাঁর অঞ্চলের মানুষরা খুবই উৎসাহী। তাদের অঞ্চলের প্রথম হাজি।
সেই সময় হজ্ব যাত্রাও ছিল দুরূহ। পাসপোর্টের প্রচলন ছিল না। পারমিট দেয়া হতো বোম্বাই শহরে। সেখান থেকে জাহাজে করে সমুদ্রযাত্রা। অনেকে বোম্বাই পর্যন্ত যেতেন, শেষমুহূর্তে জাহাজে উঠতে পারতেন না। অসুস্থ হয়ে পড়তেন, কিংবা জাহাজ ছেড়ে দিত। তারা নিজ অঞ্চলে ফিরে এসে হাজিদের মতোই জীবন যাপন করতেন। তাদেরকে বলা হতো ‘বোম্বাই হাজি’। অঞ্চলের মানুষরা তাদেরকেও যথার্থ সম্মান করত।
মান্না মিয়া তার অঞ্চল থেকে নৌকায় এবং পায়ে হেঁটে নেত্রকোনায় উপস্থিত হলেন। নেত্রকোনা থেকে ট্রেনে করে যাবেন গোয়ালন্দ। সেখান থেকে স্টিমারে কোলকাতা। কোলকাতা থেকে আবার ট্রেনে করে বোম্বাই শহর। দীর্ঘ ভ্রমণ।
তাঁর অঞ্চলের লোকজন তাকে অতি সমাদরে ট্রেনে তুলে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বিদায় নিল। ট্রেন ছেড়ে দেবার পর তিনি লক্ষ করলেন তাঁর কোমরে বাঁধা টাকার খুঁতি (টাকা রাখার কাপড়ের ব্যাগ। ফিতা দিয়ে কোমরে বাঁধা থাকে) নেই। কখন কোমর থেকে ফিতা খুলে পড়ে গেছে তিনি জানেন না। মান্না মিয়ার মনে হলো তিনি নিশ্চয়ই তার অজ্ঞাতে কোনো কঠিন পাপ করেছেন। যে কারণে আল্লাহপাক শেষ মুহূর্তে তার হজ্ব যাত্রা বাতিল করেছেন।
ট্রেন কোনো একটা স্টেশনে থামল। তিনি কম্বল এবং চটের বস্তা হতে অচেনা অজানা এক স্টেশনে নেমে পড়লেন। প্রতিজ্ঞা করলেন বাকি জীবন তিনি তার অজ্ঞাত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। আল্লাহপাক যদি ক্ষমা করেন তাহলে তিনিই আবার হজ্বের ব্যবস্থা করবেন। মান্না মিয়া তখনই নিজের অঞ্চলে ফিরবেন। তাঁর নামের আগে থাকবে হাজি।