মহল বললেন, কী হয়েছে? নাটক দেখবে না?
সালাম সাহেব জবাব দিলেন না। তার চোখ চকচক করছে। মহল বিস্মিত হয়ে বললেন, কাঁদছ না-কি?
সালাম সাহেব চাপা গলায় বললেন, মহল, আমি আমার জীবনে ভয়ঙ্কর একটা অপরাধ করেছি। অপরাধের প্রায়শ্চিত্য করা দরকার। আমি কাল থেকে প্রায়শ্চিত্য শুরু করব।
মহল বললেন, কী অপরাধ করেছ?
সালাম জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে রাখলেন।
মহল বললেন, অফিসের টাকা পয়সা মেরে দিয়েছ?
সালাম বললেন, ছি! তুমি আমাকে চেনো না।
মহল বললেন, তাহলে কী? অফিসের কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে? তাকে নিয়ে হোটেল ফোটেলে গেছ? রুম ভাড়া করেছ?
সালাম বললেন, ছি ছি!
মহল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে উঠে আস।
সালাম বললেন, না।
মহল বললেন, নাটক না দেখলে ভাত খেতে আস। ঝিম ধরে বসে থাকবে না।
সালাম সাহেব উঠে গেলেন। স্বাভাবিকভাবে ভাত খেলেন। জর্দা দিয়ে পান খেলেন। দিনের শেষ সিগারেট খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। মাঝরাতে মহলের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন সালাম শোবার ঘরের কাঠের চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসে আছেন। মহল বললেন, এই কী হয়েছে?
সালাম বললেন, কিছু না।
চেয়ারে বসে আছ কেন?
ঘুম আসছে না।
ঘুম আসছে না কেন?
পাপটা মাথায় ঘুরছে। ভয়ঙ্কর একটা পাপ করেছি মহল।
মহল বললেন, খুন করেছ কাউকে?
সালাম বিস্মিত হয়ে বললেন, আমি খুন করব মানে? কাকে খুন করব?
মহল বললেন, পাপটা তাহলে কী? বলো আমাকে?
সালাম মাথা নিচু করে রইলেন। কিছু বললেন না।
মহল বললেন, ঘুমের ওষুধ দেই, খেয়ে ঘুমাও।
সালাম বললেন, দাও।
তিনি দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েও সারারাত জেগে বসে রইলেন। তাঁর সমস্যা সে-রাত থেকেই শুরু হলো।
চাকরি শেষ হবার আগেই রিটায়ারমেন্টে চলে গেলেন। আলাদা ঘরে বাস করতে লাগলেন। সারাদিন একা থাকেন। কারো সঙ্গে কথা বলেন না। রাতে ঘুমান না। তাঁকে বড় বড় সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হলো। সাইকিয়াট্রিস্টরা রোগ ধরতে পারলেন। রোগের নাম অ্যাকিউট অবসেশন। কোনো একটা বিষয় মাথার ভেতর গভীরভাবে গেঁথে গেছে। এই রোগ সারাতে হলে পাপটা কী তা জানতে হবে। সালাম সাহেব এই বিষয়ে কিছুই বলবেন না। তাঁর স্ত্রী নানানভাবে চেষ্টা করলেন। যেমন–
মহল : শোন, তুমি কি বাসার কাজের মেয়ের সঙ্গে কিছু করেছ? করে থাকলে বলো। আমি কিছুই মনে করব না।
সালাম : ছি মহল, ছি! আমি কি এত ছোট!
মহল : অফিসের গাড়ি নিয়ে আসার সময় গাড়ির ড্রাইভার কাউকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে?
সালাম : না।
মহল : আচ্ছা শোন! তুমি কি সমকামী? এই নিয়ে কোনো সমস্যা?
সালাম : মহল, তুমি আমাকে নিয়ে এত নোংরা চিন্তা কীভাবে করছ?
এই পর্যায়ে সালাম সাহেবের স্ত্রী আমার কাছে কেঁদে পড়লেন। তার ধারণা আমি কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি ভদ্রলোককে নিয়ে আমার বাসায় উপস্থিত হলেন। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। সাধারণ কথাবার্তা। আমি তাকে চা খেতে দিলাম। তিনি আগ্রহ নিয়ে চা খেলেন। আমি বললাম, ভাই পাপের ডেফিনেশন কী? কোনটাকে আপনি পাপ ভাবেন?
তিনি বললেন, যেটা ইমমোরাল সেটাই পাপ।
আমি বললাম, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মোরালিটি বদলায়। একটা সময় ছিল যখন বিবাহ নামের ইনস্টিটিউশন তৈরি হত না। তখন যে-কোনো ছেলে যে কোনো মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে পারত। কেউ বিষয়টাকে ইমমোরাল ভাবত না। এখন ভাবে।
সালাম সাহেব বললেন, আপনার কথা বুঝতে পারছি।
আমি বললাম, আপনি কি কোনো ইমমোরাল কাজ করেছেন?
তিনি বললেন, জি-না, তবে তার চেয়েও অনেক বড় পাপ করেছি।
সেটা কি আপনি বলবেন না?
জি-না।
আপনার কারণে আপনার স্ত্রী কষ্ট পাচ্ছেন। আপনার বাচ্চারা কষ্ট পাচ্ছে। এটাকে কি আপনার পাপ বলে মনে হয়?
সালাম সাহেব বললেন, জি পাপ। তবে আমি যে পাপ করেছি তার চেয়ে অনেক ছোট পাপ।
এখন পাপের প্রায়শ্চিত্য করছেন?
জি। যেদিন প্রায়শ্চিত্য শেষ হবে সেদিনই আমি স্বাভাবিক হয়ে যাব। আমি আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
তিনি কি ক্ষমা করবেন?
বুঝতে পারছি না। যে ভয়ঙ্কর পাপ করেছি ক্ষমা পাওয়ার কথা না। তারপরেও তিনি রহমানুর রাহিম। সালাম সাহেব এক পর্যায়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাড়ির সামনের কাঁঠাল গাছের নিচে পাটি পেতে বসে থাকেন। খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ।
মিসির আলী বললেন, গল্প শেষ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, গল্প শেষ মানে? সালাম সাহেবের কী হলো? উনি পাপটা কী করেছেন বলবেন না?
মিসির আলী হাই তুলতে তুলতে বললেন, সালাম সাহেবের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে পাপটা কী সেটা মনে হয় জানি। অসুস্থ অবস্থায় যখন বিছানায় পড়েছিলাম তখন চিন্তা করে বের করেছি।
আমি বললাম, বলুন শুনি।
মিসির আলী বললেন, আমি গল্পের শুরুতেই বলেছিলাম সালাম সাহেবের গল্পটা আপনার মাথায় ঢুকে গেছে। এই গল্প মাথায় নিয়ে আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। অসংখ্যবার আপনার মনে হবে সালাম সাহেব পাপটা কী করেছিলেন। উত্তর পাবেন না।
আমি বললাম, আপনি সত্যি বলবেন না?
মিসির আলী গম্ভীর গলায় বললেন, না।
হাজি মান্না মিয়া (পাপ-২)
হাজি মান্না মিয়ার গল্প আমি বড়চাচার মুখে শুনেছি। বড়চাচা রসিক মানুষ ছিলেন, তিনি হাজি মান্না মিয়ার বোকামির গল্পগুলো মজা করে করতেন। আমি তেমন মজা পেতাম না। গ্রামের মানুষদের রসিকতার প্যাটার্নটা আমাকে কখনো আকর্ষণ করে না। হাজি মান্না মিয়াকে নিয়ে প্রচলিত সবচে’ মজার গল্পটা বললেই গ্রাম্য রসিকতার প্যাটার্নটা বুঝা যাবে। মান্না মিয়া সপ্তাহে একদিন (বৃহস্পতিবার) রোজা রাখতেন। ক্ষুধা সহ্য করতে পারতেন না বলেই তিনি দুপুরের পর থেকে অস্থির হয়ে পড়তেন। ভেজা গামছা মাথায় দিয়ে পাটি পেতে গাছতলায় বসে থাকতেন। তখন যার সঙ্গে উনার দেখা হতো উনি বলতেন, প্রতি সপ্তাহের একদিন রোজা রাখতে হবে এমন কোনো বিধান নাই। এই শেষ, রোজা আর রাখব না। ইফতারের টাইম হবার আগেই তিনি আযান দিয়ে রোজা ভেঙে ফেলতেন। পরের বৃহস্পতিবার আবার রোজা রাখা হতো।