তুমি কি তার সঙ্গে দেখা করতে যাও?
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যাই স্যার। প্রায়ই যাই। আমরা এমনভাবে কথা বলি যেন আমাদের আসলেই বিয়ে হয়েছে। আমরা স্বামী স্ত্রী। সে আমাকে তুমি তুমি করে বলে, আমিও তাকে তুমি তুমি করে বলি। দুইজন আবার রাগারাগি ঝগড়াঝাটিও করি।
কী নিয়ে ঝগড়াঝাটি করো?
নাটকে পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করেছি শুনে রাগারাগি করল। তারপর একদিন রাগারাগি করল ছেলেমেয়েদের নাম রাখা নিয়ে।
ছেলেমেয়েদের নাম মানে?
কোনো এক দিন তো জাহেদা জেল থেকে বের হবে। আমরা বিয়ে করব। আল্লাহপাকের দয়া হলে আমাদের ছেলেমেয়ে হবে। বিভিন্ন নাম নিয়ে জাহেদার সঙ্গে কথা বলি। আমার কোনো নামই তার পছন্দ হয় না। এই নিয়ে ঝগড়া। স্যার, আপনি কি আমার বড় মেয়েটার নাম রেখে দিবেন? আমি স্বপ্ন দেখেছি আমার প্রথম সন্তান মেয়ে। জাহেদাও একই স্বপ্ন দেখেছে।
শাহ্ মকবুল শব্দ করে কাঁদছে। আমি তার পিঠে হাত রেখে বললাম, তোমাদের বড় মেয়ের নাম অবশ্যই আমি রেখে দেব। পৃথিবীর সবচে’ সুন্দর নামটা তার জন্যে। তোমার মেয়ের নাম চন্দ্রাবতী। নাম পছন্দ হয়েছে?
শাহ্ মকবুল মেঝেতে কদমবুসি করে বলল, খুব পছন্দ হয়েছে স্যার। মেয়ের মায়েরও পছন্দ হবে ইনশাল্লাহ।
সালাম সাহেবের পাপ (পাপ-৩)
মিসির আলি আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, ‘অবসেশন’ শব্দটার বাংলা কী বলুন তো!
আমি খানিকটা ধাঁধায় পড়ে গেলাম। চট করে মাথায় কিছু আসছে না। তাই তো, অবসেশনের ঠিক বাংলাটি কী?
মিসির আলি মিটিমিটি হাসছেন। সচরাচর তাঁকে হাসতে দেখা যায় না। তার হাসি দেখে ভালো লাগছে। বেচারা দীর্ঘদিন রোগভোগ করে কাহিল হয়ে আছেন। পনেরো দিন পর গতকাল প্রথম শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছেন। আমি গিয়েছি রোগী দেখতে।
মিসির আলি আবার বললেন, অবসেশনের বাংলা বলতে পারছেন না, তাই না?
আমি বললাম, মাথায় আসছে। মুখে আসছে না।
মিসির আলি বললেন, ইংরেজি অনেক শব্দ আছে যার সঠিক বাংলা নেই। আবার অনেক বাংলা শব্দও আছে যার ইংরেজি হয় না। যেমন– ‘অভিমান’। অভিমানের ইংরেজি বলতে পারবেন?
আমি বললাম, ভাষাতত্ত্ব থাকুক, আপনার শরীর কেমন বলুন।
মিসির আলি বললেন, শরীর সেরে গেছে। এইজন্যে মনটা সামান্য খারাপ। শরীর সারায় মন খারাপ কেন?
মিসির আলি বললেন, শরীর যখন খুব খারাপ থাকে তখন মনের অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়। ঘোরলাগা ভাব তৈরি হয়। এই অবস্থাটা আমার পছন্দের। ঘোরলাগা অবস্থায় কোনো কিছু ভাবতে ভালো লাগে।
আমি বললাম, চেষ্টা করুন আবার যেন অসুখে পড়তে পারেন। শীতের সময় আছে, ধানমণ্ডি লেকের নোংরা পনিতে ডুব দিয়ে এলে কেমন হয়?
খারাপ হয় না। চলুন যাই।
মিসির আলি খাট থেকে নেমে গেলেন। আমি আঁৎকে উঠলাম। উনি কি সত্যি লেকে গোসল করার কথা ভাবছেন? মিসির আলী জাতীয় মানুষরা উদ্ভট কর্মকাণ্ড পছন্দ করে। আমি বললাম, যাচ্ছেন কোথায়?
মিসির আলী বললেন, আপনাকে একজন মানুষের ছবি দেখাব।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলাম। মিসির আলী বললেন, আপনি কী ভেবেছিলেন? লেকে গোসল করার জন্য টাওয়েল আনতে যাচ্ছি?
আপনাকে দ্রুত খাট থেকে নামতে দেখে সেরকমই ভেবেছি।
আমি খুবই সাধারণ মানুষ। ‘অ্যাকসেনট্রিক’ কেউ না। আমি একজন অ্যাকসেনট্রিক মানুষের ছবি আপনাকে দেখাব। ভালো কথা, ‘অ্যাকসেনট্রিক’ শব্দটার বাংলা বলুন তো?
.
আমার হাতে একজন বুড়ো মানুষের সাদাকালো ছবি। মাথাভর্তি আইনস্টাইনের মতো চুল। সব চুল সাদা। বড় বড় চোখ। তিনি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন।
মিসির আলী বললেন, ছবি দেখে লোকটাকে কেমন মনে হচ্ছে?
ভালোমানুষ মনে হচ্ছে।
ভালোমানুষ মনে হচ্ছে কেন? চোখ বড় সেই জন্যে? সরু চোখের মানুষরা ভালো হয় না? সব জাপানি কি খারাপ?
আমি বললাম, আপনার সঙ্গে কূটতর্কে যেতে চাচ্ছি না। কী বলবেন বলুন।
মিসির আলী বললেন, ভদ্রলোকের নাম মোহম্মদ সালাম। কৃষি ব্যাংকে কাজ করতেন। এখন রিটায়ার করেছেন। অতি ভালোমানুষ! দুই ছেলে এক মেয়ে এবং স্ত্রী নিয়ে সুখী সংসার। তাঁর বড় ছেলেটি ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়।
ভদ্রলোকের ছবি নিয়ে ঘুরছেন কেন?
একটু আগে ‘অবসেশন’ শব্দটা নিয়ে কথা বললাম না? ঐ ভদ্রলোকের একটা ভয়াবহ অবসেশন আছে। যখন আমি অসুখে পড়েছিলাম তখন ভদ্রলোকের অবসেশনটা নিয়েই ভেবেছি। তার অবসেশনের গল্পটা শুনবেন?
শোনার মতো হলে শুনতে পারি।
শোনার মতো তো বটেই, তবে ছোট্ট সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
ভদ্রলোকের গল্প শুনলে তার অবসেশন আপনার ভেতর ঢুকে যেতে পারে। তার ফল শুভ হবে না।
গল্পটা বলুন।
মিসির আলী বললেন, চা বানিয়ে আনি। চা খেতে খেতে বলি। আপনি খাটে পা উঠিয়ে আরাম করে বসুন।
আমি আরাম করে বসেছি। চা খাচ্ছি। রাত নয়টার মতো বাজে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মিসির আলী খাটে হেলান দিয়ে গল্প বলছেন।
মোহাম্মদ সালাম সাহেব এরকম এক বর্ষার রাতে বাড়ির সবাইকে নিয়ে টিভিতে কী একটা নাটক দেখছিলেন। হাসির কোনো নাটক। সবাই হাসছে। তিনিও হাসছেন। নাটকের মাঝখানে হঠাৎ তিনি উঠে বারান্দায় চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ হলো তিনি ফিরছেন না। তার স্ত্রী, উনার নাম মহল, স্বামীর সন্ধানে বারান্দায় এসে দেখেন– ভদ্রলোক বেতের চেয়ারে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন।