মকবুল, তুমি বাড়তি কথা না বলে মূল গল্পটা বলো। বিয়েটা কীভাবে ভাঙল।
আমার বাবা শাহ জলিল একটু দূরে কাঠের চেয়ারে বসেছিলেন। কন্যার পিতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পান খাবেন কি-না। বাবা বলেন, আমি চা-পান বিড়ি সিগারেট এইসব খাই না।
কন্যার পিতা বললেন, লেবুর সরবত করে দেই, সরবত খান। বাবা বললেন, আচ্ছা।
কন্যার পিতার সরবত আনতে গেলেন, তখন হঠাৎ বাবার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি চিৎকার শুরু করেন—’আমি বিবাহ করব না। আমি বিবাহ করব না।’
চারদিকে হাসাহাসি পড়ে গেল। পাগলের যে-কোনো কথায় লোকজন হাসে। আর এই পাগল হাসির কথাই বলছে। ছেলেকে বিবাহ করাতে এসে বলছে- আমি বিবাহ করব না। বিরাট বেইজ্জতি ব্যাপার।
কন্যার এক মামা বিডিআর-এ কাজ করেন। নন কমিশন্ড অফিসার। সুন্দর চেহারা, কথাবার্তায় অতি ভদ্র। তিনি এসে হাতজোড় করে বললেন, আপনারা যদি কিছু মনে না করেন, কন্যার মা কান্নাকাটি করতেছেন। তিনি এইখানে মেয়ে বিবাহ দিবেন না।
আমাদের সঙ্গেও ভালো ভালো লোকজন ছিল। নেত্রকোনা কোর্টের উকিল অধর বাবু ছিলেন। দেওয়ানি ফৌজদারি দুই মামলাতেই তিনি মারাত্মক। তিনি একবার এক সাক্ষিকে এমন জেরা করলেন যে, সাক্ষি এজলাসে পেসাব-পায়খানা করে ফেলল। জজ সাহেব বিরক্ত হয়ে অধর বাবুকে দশ টাকা ফাইন করলেন। মেথর দিয়ে এজলাস পরিষ্কার করার খরচও অধর বাবুকে দেয়া লাগল।
মকবুল, মূল গল্পটা বলো। শাখা-প্রশাখা বাদ দাও।
কন্যার মামার কথা শুনে অধর বাবু গেলেন ক্ষেপে। তিনি বললেন, কন্যার মা এইখানে কন্যার বিবাহ দিবেন না, ভালো কথা। মা হিসাবে এই কথা বলার অধিকার অবশ্যই তাঁর আছে। আমরা তাঁর কথাকে সম্মান করি। কিন্তু এই কথা তিনি আগে কেন বললেন না। শেষ সময়ে কেন বললেন। ছেলের বাবার মাথা যে সামান্য গরম এই কথা তো কন্যার মাতা আগেই জানতেন। এমন তো না যে আজ প্রথম খবর পেয়েছেন। আমরা ছেলে বিবাহ দিতে এসেছি। ছেলে বিবাহ দিব। কন্যা ছাড়া গ্রামের ফিরে বেইজ্জত হব না। আপনারা যদি বিবাহ না দেন– দুই তিনটা ধারায় ফৌজদারি মামলা হবে। কারোর কারোর চার-পাঁচ বছরের জেল জরিমানা হবে। এখন বুঝে দেখেন। আমি অধর উকিল। আইনের কথা বুঝি। আইন ছাড়া কিছু বুঝি না।
বিরাট তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। হৈচৈ চিৎকার। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলছেন শুধু অধর বাবু।
অধর বাবুর বক্তৃতায় কাজ হলো। এদিকে বাপজান সামান্য ঠাণ্ডা হয়েছেন। চেয়ারে এসে বসেছেন। গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেলেছিলেন, সেই পাঞ্জাবি আবার পরেছেন। কাজি সাহেবও চলে এসেছেন। কন্যার বাবা বললেন, বিবাহ হবে– দুইজন আসেন। মেয়ের এজিন নিয়ে যান।
আমাদের দুই মুরব্বি এজিন আনতে গেলেন। অধর বাবুও সঙ্গে গেলেন। উনি বিচক্ষণ লোক। উনি দেখবেন সব ঠিকঠাক হচ্ছে কি-না।
হঠাৎ শুনি ভিতর থেকে চিৎকার। হৈচৈ। মনে হচ্ছে মারামারি শুরু হয়েছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই এক দল লাঠিসোঠা নিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। কী যে ভয়ঙ্কর অবস্থায়। ষণ্ডাগুণ্ডা ধরনের জোয়ান ছেলেপুলে। কন্যার বাবা এবং মামা মারামারি থামানোর চেষ্টা করছেন। ছোটাছুটি করছেন। কোনো লাভ হচ্ছে না। এই সময় তারা এসে আমার গলা চেপে ধরল। আমাকে মেরেই ফেলত। তখন বিয়ের কন্যা জাহেদা ছুটে এলো। সে না এলে আমাকে মেরে ফেলত।
আমি বললাম, তুমি বলেছিলে বিয়ের কন্যা জাহেদাকে আগে দেখ নি। তোমার বড় খালা দেখেছিলেন।
স্যার, মিথ্যা বলেছিলাম।
কেন? মানুষ উদ্দেশ্য ছাড়া মিথ্যা বলে না। তোমার উদ্দেশ্যটা কী?
স্যার, আপনি জ্ঞানী মানুষ।
আপনি উদ্দেশ্য খুঁজে বের করেন। আমি উদ্দেশ্য জানি না। জাহেদাকে দেখেছি এটা বলতে আমার লজ্জা লাগে বলেই বলি দেখি নাই।
লজ্জা লাগবে কেন?
বিয়ে হওয়ার কথা ছিল হয় নাই, এইটাই লজ্জা। সব মানুষ তো এক রকম হয় না স্যার। একেক মানুষ হয় একেক রকম।
তারপর কী হয়েছে বলো।
শাহ্ মকবুল স্বাভাবিক গলায় বলল, দুইজন মানুষ মারা গিয়েছিল। অধর বাবুর ঠ্যাং ভেঙে জন্মের মতো লুলা করে দিয়েছিল।
বলো কী?
দুইজন এজিন আনতে গিয়েছিল। দুইজনেই শেষ। একজনকে গলায় ছুরি বসায়ে গরু জবাই করার মতো জবাই করেছে।
সর্বনাশ!
অনেক পত্রপত্রিকায় এই ঘটনা উঠেছে। ইত্তেফাঁকে লেখা হয়েছে– বিয়ের আসরে কারবালা। নিহত দুই। আহত শতাধিক।
এরপর শুরু হলো মামলা-মোকদ্দমা। অধর বাবু মামলা সাজালেন। প্রধান আসামি তিনজন। বিয়ের কন্যা জাহেদা, তার বাবা এবং তার মা। অধর বাবু নিজে একজন সাক্ষি। তিনি বললেন যে, তিনি নিজে দেখেছেন, জাহেদা গলায় ছুরি বসাচ্ছে। বাকি দুইজন চেপে ধরে আছে।
অথচ স্যার এই তিনজন কিছুই করে নাই। আটকানোর চেষ্টা করেছে। জাহেদা যদি ছুটে এসে আমাকে না আটকাত, তাহলে আমাকেও মেরে ফেলত।
তুমি সাক্ষি দাও নি?
দিয়েছি। সত্য কথা বলেছি। আমি একা বলেছি একধরনের কথা, বাকি চল্লিশজন সাক্ষি বলেছে ভিন্ন কথা। আমার সাক্ষি কোর্ট গ্রহণ করে নাই। উকিল প্রমাণ করেছে যে, আমি পাগল। আমার বাবা পাগল, আমি ও পাগল। পাগল বলেই সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছি।
শাস্তি কী হয়েছিল?
স্যার তিনজনেরই ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। জাহেদার অল্প বয়সের কারণে এবং মেয়ে হবার কারণে হাইকোর্ট পরে যাবজ্জীবন দিয়েছে।