আমি ধরেই নিলাম প্রুফ রিডার মতির দেখা আর পাওয়া যায় না। সে প্রুফ ভালো দেখত তাতে সন্দেহ নেই। আমার মতো বানানে দুর্বল লেখকের জন্যে এটা দুঃসংবাদ। নতুন প্রফ রিডার আবদুস সাত্তার নানান যন্ত্রণা করছে, কথ্য কথাবার্তা সে নিজ দায়িত্বে সাধুভাষা করে দিচ্ছে। উদাহরণ দেই–আমি লিখলাম, বিরাট ভুখ লাগছে। চা খামু না। ভাত দেও।
সে শুদ্ধ করে ঠিক করল– খুব ক্ষুধা লেগেছে। চা পান করব না। ভাত দাও।
আমার মাথায় বাড়ি। সে শুধু যে ভাষা ঠিক করছে তা-না। কিছু কিছু অংশ ফেলেও দিচ্ছে। কাজটা কেন করছে জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে। এর চেহারাও সন্ত্রাসীর মতো কঠিন ধমক দিতে ভয় লাগে। আমার লেখালেখি বন্ধ হবার জোগাড়।
দিন দশেকের মাথায় সমস্যার সমাধান হলো। এক সকালে চা খাচ্ছি শাহ মকবুল কাটা প্রুফ নিয়ে উপস্থিত। আমি আনন্দিত গলায় বললাম, আরে মকবুল তুমি?
মকবুল বলল, স্যার অভিনয় ছেড়ে দিয়েছি। আমার পুষল না।
পুষল না কেন?
সবাই পাগলের চরিত্র করতে বলে। আমি পাগল করব না। রাস্তায় যখন বের হই, লোকে ভাবে পাগল।
অভিনয় যে ভালো করছ এটা তার প্রমাণ।
সবাই পাগল বললে একসময় পাগল হয়ে যাব। জগতের এটাই নিয়ম। মানুষের মুখে যা রটে তাই হয়।
কে বলল এই কথা?
আপনার লেখার মধ্যেই পড়েছি স্যার। আপনি লিখেছেন, মানুষের মুখে জয় মানুষের মুখে ক্ষয়। কোন লেখা সেটা মনে নাই। এটার অর্থ মানুষ যাকে নিয়ে জয় জয় করে তার জয় হয়। আর যাকে নিয়ে ক্ষয় ক্ষয় করে তার ক্ষয় হয়। অর্থটা কি স্যার ঠিক আছে?
হ্যাঁ, ঠিকই আছে।
শুটিং-এ যখন যাই তখন ডিরেক্টর সাহেব বলেন, এই পাগলাটারে এক কাপ চা দে। মনটা এত খারাপ হয়। প্রডাকশনের ছেলেপেলেরা আমাকে ডাকে পাগলা স্যার।
আমি বললাম, আমাদের সমাজে পাগল বা পাগলা আদর অর্থে ব্যবহার হয়। আমরা যখন বলি, ছেলেটা পাগলা আছে তখন বুঝাতে হয় ছেলের কাজকর্ম মজার।
স্যার, আমি পাগলের আর কোনো চরিত্র করব না।
আচ্ছা ঠিক আছে। চা খাও।
সে চা খেতে কাটা প্রুফ মিলাতে বসল। ঘণ্টাখানিক লাগবে। কাজ শেষ করে আমাকে দেখিয়ে চলে যাবে। আমি শোবার ঘরে চলে এলাম। নতুন একটা রকিং চেয়ার কেনা হয়েছে। দোল খেতে খেতে টিভির চ্যানেল বদলাতে মজা লাগে। দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে চ্যানেল বদলাচ্ছে। ঠিকমতো সিনক্রোনাইজ করতে পারলে আনন্দময় ব্যাপার। দুলুনি থামতে হলো, কারণ কাজের ছেলে এসে বলল, ‘লোকটা কানতেছে।’ আমি তৎক্ষণাৎ উঠে গেলাম। শাহ মকবুল লাল নীল পেনসিল নিয়ে মেঝেতে উবু হয়ে বসেছে। প্রুফ দেখছে যথেষ্ট মন লাগিয়ে, একই সঙ্গে টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
আমি বললাম, মকবুল, কী হয়েছে?
মকবুল আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, মনটা খারাপ।
কেন?
আপনার একটা লাইন পড়ে হঠাৎ মনটা খারাপ হয়েছে। আর ঠিক হচ্ছে না। আমার এরকম হয়।
কোন লাইনটা?
মকবুল লাল কালিতে দাগ দিয়ে প্রুফ আমার হাতে দিয়ে চোখ মুছতে লাগল। মন খারাপ করার মতো কোনো লাইন না। লেখা আছে– সালমা বলল, তুমি মনে করে একটা ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ কিনে এনো। মনে থাকবে তো? তোমার তো আবার কিছুই মনে থাকে না।
আমি বললাম, সালমা নামের পরিচিত কেউ কি আছে?
মকবুল বলল, জি-না স্যার। স্বামীর-স্ত্রীর মিল মুহাব্বতের কথা কী সুন্দর করে লিখেছেন।
আমি বললাম, মকবুল, তুমি বিয়ে করছ?
মকবুল বলল, জি-না স্যার। বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট হবার দুই মাস পরে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। মেয়ের নাম জাহেদা। বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল। তারপর আর বিয়ে করি নাই।
কত বছর আগে বিএ পাস করেছ?
পনেরো বছর আগে।
জাহেদা কি খুব রূপবতী ছিল?
স্যার, আমি দেখি নাই। আমার বড়খালা দেখেছিলেন। তিনি বলেছেন মেয়ে শ্যামলা, তবে মুখের কাটিং ভালো। মাথায় চুল আছে। ইন্টার পাস। গ্রামের মধ্যে ইন্টার পাস মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তারচে’ বড় কথা শ্যামলা মেয়ের অন্তর হয় ফর্সা, আর ফর্সা মেয়ের অন্তর হয় শ্যামলা।
কে বলেছে?
আপনার এক লেখাতে পড়েছি।
বিয়েটা ভাঙল কেন?
মকবুল ধরা গলায় বলল, বিরাট হিস্টোরি স্যার। শুনলে আপনার খারাপ লাগবে।
খারাপ লাগলে লাগবে। শুনি তোমার গল্প।
আপনি যদি লিখে ফেলেন বিরাট বেইজ্জত হব।
আমি লিখব না। শোনা গল্প আমি কখনো লিখি না।
আর লিখলেও ক্ষতি নাই। কেউ তো আর বুঝবে না আপনি আমার মতো অধমরে নিয়া লিখছেন। ঠিক বলেছি স্যার?
ঠিকই বলেছ।
গল্পটা শুরু করি স্যার। আমার বাবারে দিয়া শুরু করি। আসলে এই গল্প উনারই। আমি কেউ না। আমার বাবা ছিলেন পাগল। আমার বিবাহে বরযাত্রী হয়ে বাবা সঙ্গে গিয়েছিলেন। সব ঠিকঠাক ছিল। বাবা ছিলেন শান্ত। সবার থেকে সামান্য দূরে একটা কাঠের চেয়ারে বসেছিলেন। কাজি আসতে বিলম্ব করছিল এই জন্য অপেক্ষা। দিনটা ছিল শুক্রবার। এই দিনে গ্রামাঞ্চলে অনেক বিয়ে শাদি পড়ানো হয়। কাজিরা থাকেন ব্যস্ত। কপালের ফের এরেই বলে। কাজি যদি দেরি না করতেন, তাহলে আমার বিয়েটা হয়ে যায়। এত দিনে তিন চারটা ছেলেমেয়ে হয়ে যেত। যদিও সরকার বলছে ছেলে হোক মেয়ে হোক একটি সন্তানই যথেষ্ট, কিন্তু আমার বাড়িভর্তি ছেলেমেয়ের শখ। ছেলেমেয়েরা চিল্লাপাল্লা করবে আমোদ ফুর্তি করবে। তাদের মাতা চড় থাপ্পড় মারবে এর নাম সংসার।