পুরো বিষয়টাই হাস্যকর। কিন্তু আমার নজর আটকে গেল অন্য জায়গায়, ফুচকাওয়ালার দিকে। ফুচকাওয়ালা আমাদের শাহ্ মকবুল। নায়ক-নায়িকার কথা শোনা ছাড়া তার করণীয় কিছুই নেই। কিন্তু এই কাজটা সে করল প্রফেশনাল অভিনেতাদের মতো। মাঝে মাঝে আগ্রহ নিয়ে নায়ক নায়িকার কথা শোনে। মুচকি হাসে। একটা ফুচকা বানিয়ে এক ফাঁক খেয়ে ফেলল। পকেট থেকে সিগারেট বের করল। ধরাবে কী ধরাবে না কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবার পকেটে রেখে দিল। ডিরেক্টর সাহেব যদি এসব তাকে বলে দিয়ে থাকেন, তাহলে বলতেই হবে তিনি বড় ডিরেক্টর। নায়ক-নায়িকার অভিনয় দেখে আমার অবশ্যি সেরকম কিছু মনে হলো না।
পরের বার শাহ্ মকবুল যখন প্রুফ নিয়ে এলো, আমি বললাম, এই তুমি অভিনয় করো না-কি?
মকবুল মাথা নিচু করে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, টুকটাক করি স্যার।
তোমার অভিনয় কিন্তু ভালো।
ভালো পার্ট পাই না স্যার। ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা এইসব পাই।
তোমার ফুচকাওয়ালার একটা অভিনয় দেখেছি, নাটকের নাম জানি না। সেখানে তুমি ফুচকা বিক্রি করার সময় যে কাজগুলো করেছ, সেগুলো কি তোমাকে ডিরেক্টর শিখিয়ে দিয়েছেন, না নিজে নিজে করেছ?
শাহ মকবুল মাথা নিচু করে বলল, ডিরেক্টর সাহেব তো নায়ক-নায়িকা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আমরা কে? যা করার নিজে নিজেই করেছি। নাটকের নাম– হৃদয়ের ভগ্ন জানালা।
নাটক কেমন হয়েছে জানি না। তোমার অভিনয় ভালো হয়েছে। বেশ ভালো হয়েছে।
শাহ মকবুল তার বিশেষ কায়দায় কদমবুসি করল। অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল, আপনার তো অনেক জানাশোনা। যদি একজনকে বলে দেন ভায়ালগ আছে এমন একটা পার্ট যদি দেয়। সারাজীবন আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।
কেনা গোলাম হবার দরকার নেই, আমি বলে দেব।
ডাইরেক্টর মিজান ভাইকে যদি বলে দেন। উনি আপনার বিশেষ ভক্ত।
আমি বলে দেব।
উনার মোবাইল নাম্বারটা কি আপনাকে লিখে দিয়ে যাব স্যার?
দিয়ে যাও।
শাহ্ মকবুল মোবাইল নাম্বার লিখে দিয়ে চলে গেল। আমার টেলিফোন করা হলো না। ত্রুটিটা আমার না। ত্রুটি শাহ্ মকবুলের। শাহ্ মকবুল সেই শ্রেণীর মানুষ চোখের সামনে থেকে সরে গেলে যাদের কথা মনে থাকে না।
মাঝারি আকৃতির ছোটখাটো মানুষ। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে হাঁটে। নিঃশব্দে চলাফেরা করে। তার চলাফেরা কথাবার্তায় একটি জিনিসই প্রকাশ পায়– আমি অতি ক্ষুদ্র, অতি তুচ্ছ। রাস্তায় সিএনজি বেবিটেক্সিগুলোর মতো। যাদের পেছনে লেখা থাকে–
আমি ছোট। আমাকে ধাক্কা দেবেন না। এক ছুটির দিনের কথা। বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছি। আয়োজন করে চা খাচ্ছি। হাতে পত্রিকা। মামারারি-কাটাকাটির খবর দিয়ে যেন দিনের শুরু না হয় সেজন্যে ভিতরের দিকের পাতা পড়ছি। সংস্কৃতি সংবাদ। এক মডেল কন্যার বিশাল ছবি ছাপা হয়েছে। স্লিভলেস জামা গায়ের এই নায়িকার বয়স সতের। তিনি ইন্টার পাস করেছেন। তার পছন্দ-অপছন্দের বিশাল তালিকা ছাপা হয়েছে। আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। তিনি জানাচ্ছেন যে, অশ্লীল ছবিতে তিনি কখনোই অভিনয় করবেন না। ভালো সামাজিক ছবিতে অভিনয় করবেন। এবং ছবির স্বার্থে চুম্বন দৃশ্য করতে তিনি রাজি আছেন। তাঁর আদর্শ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ), প্রিয় অভিনেতা শাহরুখ খান। প্রিয় লেখক শেক্সপিয়র, কার্লমার্কস এবং ভিক্টর হুগো। ভিক্টর হুগোর কোন্ কোন্ বই পড়েছেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন যে, প্রায় সব বই-ই পড়েছেন, তবে এই মুহূর্তে বইয়ের নাম মনে করতে পারছেন না। মডেল কন্যার প্রিয় রঙ নীল। প্রিয় খাদ্য চেপা শুঁটকি এবং পিজা।
মডেল কন্যার শখ এবং প্রিয় অপ্রিয়ের তালিকা পড়ে যথেষ্টই আনন্দ পেলাম। এরকম আনন্দদায়ক আইটেম আরো আছে কি-না দেখতে গিয়ে শাহ্ মকবুলের ছবির দিকে চোখ আটকে গেল। সে এই প্রান্তিকের সেরা অভিনেতার পুরস্কার নিচ্ছে। মিজানুর রহমানের মেগা সিরিয়েল হলুদ কাল নীল-এ সে মতি পাগলের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছে। মতি পাগলের একটা ডায়ালগ সুপার হিট করেছে। লোকজনের মুখে মুখে ফিরছে। ডায়ালগটা হচ্ছে- ভাত খামু না চাপায় বেদনা। বেশ কিছু রিকশা, বেবিটেক্সি এবং বাসের পেছনে এখন নাকি এই কথা লেখা।
আমি ঘর থেকে বিশেষ বের হই না বলে ‘ভাত খামু না চাপায় বেদনা লেখা আমার দেখা হয় নি। তবে শাহ্ মকবুল যে অভিনয় নিয়ে যথেষ্টই ব্যস্ত এটা বুঝলাম যখন দেখলাম প্রুফ নিয়ে সে আসা-যাওয়া করছে না। অন্য একজনকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অবসর সময়ে টিভি দেখার অভ্যাসও আমার নেই। কাজেই শাহ্ মকবুল অভিনয় কেমন করছে তাও জানি না।
একদিন শাওন খুবই উত্তেজিত গলায় বলল, তোমার ঐ লোক তো ফাটাফাটি অভিনয় করে।
আমার কোন লোক?
ঐ যে প্রফ রিডার মকসুদ না মকবুল কী নাম। মতি পাগলার ভুমিকায় অভিনয় করছে দেখে মনেই হয় না অভিনয়। দেখে মনে হয় সত্যি সত্যি কোনো এক পাগলকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছে। গলার মডুলেশন এত চমৎকার।
‘ভাত খামু না চাপায় বেদনা’ যে সত্যি হিট করেছে তার একটা প্রমাণ পেলাম। গাড়ি করে গাজীপুর যাচ্ছি। সিগন্যালে গাড়ি থেমেছে। ফুল বিক্রি করে ছেলেমেয়েরা প্রায় ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আট’ন বছর বয়েসী একটা মেয়ের চেহারা এতই মায়াকাড়া। তার হাতে ছোট ছোট হলুদ রঙের কয়েকটা গোলাপ। গোলাপের চেয়েও মেয়েটার চেহারা সুন্দর লাগছে। গোলাপগুচ্ছের দাম পনেরো টাকা। আমি তাকে বিশ টাকার নোট দিয়ে বললাম, এই টেকা দিয়া রুটি কিনা খামু। ভাত খামু না চাপায় বেদনা। বলেই সে ফিক করে হেসে ফেলল।