শাওনের অনেক বিচিত্র স্বভাবের একটি হচ্ছে আমার ফেলে দেয়া গল্প, অসমাপ্ত নাটক যত্ন করে তুলে রাখা। এর জন্যে তার একটা বড় টিনের ট্রাংক আছে। ট্রাংকটা আড়ং থেকে কেনা, লতা পাতা ফুল আঁকা। শাওনের ধারণা আমার ফেলে দেয়া গল্প এবং নাটকগুলো নাকি বেশি ভাল। শাহ মকবুলকে উদ্ধার করা হয়েছে শাওনের ট্রাংক থেকে। অসমাপ্ত অংশ শেষ করেছি। কি দাঁড়িয়েছে কে জানে।
*
স্যার, আমার নাম মকবুল। শাহ্ মকবুল। নামের আগে শাহ্ কী কারণে আছে জানি না। মনে হয় আমরা শাহ বংশ। আমার পিতার নাম শাহ্ জলিল। দাদার নাম শাহ্ মুদচ্ছের। আমি এই পর্যন্তই নাম জানি, এর বেশি জানি না। শাহ্ বংশ বলে কিছু আছে কি-না আপনি নিশ্চয়ই জানেন। আপনি লেখক মানুষ। লেখকরা অনেক কিছু জানেন। আমি একজন প্রুফ রিডার। আপনার মতো অনেক লেখকের লেখার প্রুফ আমি দেখি। মাঝে মাঝে এমন চমক খাই। একবার এক লেখকের লেখায় পড়লাম উইপোকা জন্মান্ধ। এক জীবনে কত উইপোকা দেখেছি, কিন্তু কখনো জানতাম না তারা জন্মান্ধ। আমি যে অশিক্ষিত, মূর্খ তাও না, বিএ পাস করেছি। রেজাল্ট ভালো হয় নি। তারপরেও বিএ ডিগ্রির আলাদা ইজ্জত আছে। গ্র্যাজুয়েট হওয়া সহজ বিষয় না। স্যার, আমি কি ভুল বললাম?
আমি হাই চাপতে চাপতে বললাম, না।
শাহ মকবুল আমার সামনে বসা। প্রুফ নিয়ে এসেছে। বাইরে সৃষ্টি হচ্ছে। সে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে। আমি ভদ্রতা করে তাকে চা খেতে বলে বিপদে পড়ে গেছি। সে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গল্প শুরু করেছে। আমি গল্পের মাঝখানে উঠে যেতে পারছি না। এতটা নিষ্ঠুরতা দেখানো যাচ্ছে না। আমি নিজে গল্প লিখি। কোনো পাঠক আমার গল্পের শুরুটা পড়ে উঠে গেলে আমার যেমন খারাপ লাগবে, শাহ মকবুলের নিশ্চয়ই ততটাই খারাপ লাগবে।
স্যার, আপনার কি কোনো জরুরি কাজ আছে?
আমি বললাম, খুব জরুরি কাজ অবশ্যি একটা আছে।
শাহ্ মকবুল বলল, আমি চা-টা শেষ করেই চলে যাব। আমার কারণে আপনার কাজের ক্ষতি হয়ে গেল।
আমি বললাম, তেমন কিছু ক্ষতি হয় নি। তুমি ধীরে সুস্থে চা শেষ করো।
আর এক চুমুক দিলেই চা শেষ হয়ে যাবে। শেষ চুমুকটা দেয়ার আগে আপনাকে একটা প্রশ্ন করব যদি বেয়াদবী না নেন। স্যার, আপনার সঙ্গে তো আমার প্রায় এক বছরের উপর পরিচয়। আপনার দু’টা বইয়ের সেকেণ্ড প্রুফ আমি দেখেছি। আপনার কি কখনো মনে হয়েছে আমি পাগল?
অবশ্যই না।
কথা একটু বেশি বলি। কথা বেশি বলা পাগলের লক্ষণ না। অনেকেই বেশি কথা বলে। পাগলরা বরং কম কথা বলে।
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, তুমি পাগল না। এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
শাহ্ মকবুল বলল, এটা কি স্যার আপনি লিখিতভাবে বলবেন?
কেন বলো তো?
আমি-বিশিষ্টজনদের সার্টিফিকেট জোগাড় করছি। অনেকেই লিখিতভাবে দিয়েছেন। আজাদ পাবলিকেশনের মালিক আব্দুস সোবাহান সাহেব দিয়েছেন। উনার মেজোমেয়ের জামাই নুরুন নবি বার এট ল, উনিও দিয়েছেন। একজন ব্যারিস্টারের সার্টিফিকেট পাওয়া তো সহজ কথা নয়। স্যার কী বলেন?
অবশ্যই।
কবি-সাহিত্যিকদের সার্টিফিকেটও আমার অনেক জোগাড় হয়েছে।
আচ্ছা যাও আমি লিখিতভাবেই দিব। যেটা বিশ্বাস করি, সেটা লিখিতভাবে বলতে আমার অসুবিধা নেই।
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র শাহ মকবুল পাঞ্জাবির পকেট থেকে কম্পিউটারে কম্পোজ করা A4 সাইজের একটা কাগজ বের করল। সেখানে লেখা–
যার জন্যে প্রযোজ্য
শাহ্ মকবুল,
পিতা : শাহ্ জলিল,
গ্রাম : নিষিন্দা,
জেলা : নেত্রকোনা। আমার পূর্ব পরিচিত। সে পাগল নহে।
(পূর্ণ নাম)
ঠিকানা :
পেশা :
তারিখ :
আমি নাম সই করতে করতে কৌতূহলী হয়ে বললাম, কী করবে এই সার্টিফিকেট দিয়ে?
শাহ্ মকবুল বলল, আমার একটা শখ। শখের তোলা আশি টাকা। স্যার আপনার কি একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি আছে? ছবিটাও ফরমটার সঙ্গে আঠা দিয়ে আটকে রাখব। দস্তখত দেখে মানুষ চেনা যায় না। ছবি দিয়ে চেনা যায়।
আমি খুঁজে পেতে এক কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবিও এনে দিলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। শাহ মকবুল বিদায় হলো। যাবার আগে তার বিশেষ কায়দায় কদমবুসি করল। পা স্পর্শ না করে পায়ের সামনের মেঝে স্পর্শ করে সালাম। কদমবুসি না বলে মেঝেঝুলি বলা যেতে পারে।
মানুষের বিচিত্র শখ নিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হবার বয়স আমার না। সেই শখের তোলা আশি টাকা হলেও না। আমি আমার এক জীবনে বহু বিচিত্র শখের মানুষ দেখেছি। চিটাগং রেলওয়ে কলোনিতে জয়নাল নামের এক রেলওয়ে কর্মচারী ছিলেন, যার শখ খাওয়া-দাওয়া শেষ করার পর মাগুর মাছের মাথা (যেদিন মাগুর মাছ রান্না হয় সেদিন} ধুয়ে মুছে জমা করে রাখা। তার সঞ্চয়ে তিনশ’র ওপর মাগুর মাছের মাথা ছিল। মাগুর মাছের মাথা জমানো যেমন নির্দোষ শখ, আমি পাগল না’-জাতীয় সার্টিফিকেট জমানোও নির্দোষ শখ। নির্দোষ শখ নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আমি শাহ্ মকবুলের কথা ভুলেই গেলাম। সে প্রফ নিয়ে আসা-যাওয়া করে, আমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয় না।
একদিন একটু অন্যভাবে দেখা হয়ে গেল। আমার স্ত্রী (শাওন) আগ্রহ নিয়ে কী একটা নাটক দেখছে দেখে আমি পাশে বসলাম। প্রেমবিষয়ক যে সব নাটক হয় সেরকমই একটা নাটক। নায়ক-নায়িকা ফুচকাওয়ালার কাছ থেকে ফুচকা নিয়ে খাচ্ছে। খুবই অস্বাভাবিক সব ডায়ালগ দিচ্ছে। যেমন নায়ক বলছে– আমার জীবনটাই ফুচকা 1 কামড়ে কামড়ে কে যেন শেষ করে দিচ্ছে। নায়িকা বলল- তাহলে এখন থেকে তোমাকে আমি ডাকব ফুচকা কুমার। বলেই সে বিকট হাঁ করল। নায়ক তার মুখে আস্ত একটা ফুচকা ঢুকিয়ে দিল। নায়িকা কামড় দিল নায়কের আঙুলে।