দেওয়া তো উচিত।
বিপদে-আপদে সবে ইটা আসবে আমার কাছে। এর বান মারতে হবে। তারে বশিকরণ মন্ত্র দিতে হবে। বান ছুটাইতে হবে। পিশাচ-সাধকের কাজের কি শেষ আছে? ঠিক বলেছি না স্যার?
ঠিকই বলেছ।
টাকা-পয়সা ধনদৌলতেরও তখন সমস্যা নাই। জমি-জিরাত করব। ঘরবাড়ি করব। শাদি করব। আমি স্যার অখনো শাদি করি নাই। ঘর নাই, দুয়ার নাই। খাওয়া খাদ্য নাই। আমার কাছে মেয়ে কে দিব কন?
পিশাচ-সাধকের কাছেও কি আর মেয়ে দিবে? মেয়ের বাবা-মার কাছে পিশাচ পাত্র হিসাবে ভালো হবার কথা না।
মকবুল দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, সেইটা কোনো বিষয় না স্যার। সাধনার শেষে যারে ইচ্ছা তারে আমি বিবাহ করতে পারব। পিশাচই ব্যবস্থা কইরা দিবে। আমার কিছু করতে হবে না।
তাই না-কি?
অত কষ্ট কইরা সাধনা যে করতেছি বিনা কারণে তো করতেছি না। আমি তো বেকুব না। এই যে আপনার সঙ্গে এত গল্প কলাম, আপনার কি মনে হয়েছে আমি বেকুব?
তা মনে হয় নাই।
পিশাচ সাধনায় যারা পাস করে, তারা ইচ্ছা করলে অন্যের বিবাহিত ইসতিরিরেও বিবাহ করতে পারে। যেমন মনে করেন, এক লোক তার পরিবার নিয়া সুখে আছে। তার দুইটা ছেলেমেয়েও আছে। আমি পিশাচ সাধনায় পাস করা মকবুল যদি সেই লোকের পরিবাররে বিবাহ করতে চাই, তাইলে সঙ্গে সঙ্গে তারার সুখের সংসারে আগুন লাগব। ছাড়াছাড়ি হইয়া যাইব। আমি আপোসে সেই মেয়েরে বিবাহ করব। সেই মেয়েও আমার জন্যে থাকবে দিওয়ানা।
এরকম কোনো পরিকল্পনা কি আছে?
পিশাচ-সাধক মকবুল মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো, এটাই তার পিশাচ-সাধনার মূল প্রেরণা। ঠোঁটের কোণে হাসিও দেখা যাচ্ছে।
কাকে বিয়ে করতে চাও। মেয়েটা কে?
আমার মামাতো বোন নাম কইতরি। তার বিবাহ হয়ে গেছে। নবীনগরের কাঠমিস্ত্রি ইসমাইলের সঙ্গে বিবাহ হয়েছে। তারার দুইটা পুত্রসন্তানও আছে। সুখের সংসার। অন্যের সুখের সংসার ভাঙলে বিরাট পাপ হয়। আমি পিশাচ, আমার আবার পাপপুণ্য কী? ঠিক বলেছি না স্যার?
আমি জবাব দিলাম না। মানুষটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কাকের খাঁচা নিয়ে আমার সামনে যে উবু হয়ে বসে আছে, সে কোনো সাধারণ মানুষ না। পিশাচ সাধনা করুক বা না করুক, সে বিরাট প্রেমিকপুরুষ।
মকবুল গলা নামিয়ে বলল, কইতরির চেহারা এমন কিছু না। গায়ের রঙ শ্যামলা। মাথার চুল অল্প। সন্তান হওনের পরে বেজায় মোটা হয়েছে। কিন্তু স্যার তার জন্যে সবসময় কইলজা পুড়ে। বুক ধড়ফড় করে। রাইতে ঘুম হয় না। আমি থাকি নবীনগরে। একদিনের জন্যেও নবীনগর ছাইড়া যাইতে পারি না। এই যে আপনের কাছে আসছি, একটা দিন থাকলে আপনের ভালোমন্দ দুইটা কথা শুনতে পারি– সেই উপায় নাই। আমার নবীনগর যাইতেই হবে।
কইতরির সঙ্গে তোমার কথাবার্তা হয়?
জে-না। তার বাড়ির সামনে দিয়া হাঁটাহাঁটি করি। কৃচিৎ তারে দেখি। একদিন দেখেছি তার ছেলেটারে নিয়া পুসকুনির দিকে যাইতেছে। সে আমারে দেখে নাই। ছেলে দুইটাও সুন্দর হয়েছে মাশাল্লাহ। বড়টার নাম গোলাপ, ছোটটার নাম সুরুজ।
সব খবরই দেখি রাখ।
কী বলেন স্যার, রাখব না! আপনে একটু দোয়া কইরেন, পিশাচ সাধনা যেন তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারি।
তুমি সাধনার কোন পর্যায়ে আছ?
মাত্র শুরু করেছি, সময় লাগব। পানিতে চুবাইয়া দশটা কাউয়া মারণ লাগব। এইটা এখনো পারি নাই। এই কাউয়াটা সাথে নিয়া ঘুরতেছি ছয় মাসের উপরে হইছে। দুইবার পুসকুনিতে নামছি এরে চুবাইয়া মারার জন্যে, দুইবারই উইঠা আসছি। জীবন্ত একটা প্রাণী পানিতে চুবাইয়া মারা তো সহজ কথা না। একবার পানিতে ডুবাইয়াই টান দিয়া তুললাম। কাউয়া কিছু বুঝে নাই। হে ভাবছে আমি তারে গোসল দিছি। পশুপাখির বুদ্ধি তো আমরার মতো না। তারার বুদ্ধি কম।
কাকটা ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরার দরকার কী?
কাউয়ার উপরে মুহব্বত জন্মাইছে। ছাইড়া দিতে মন চায় না। ছাড়লেও হে যায় না। মুহব্বতের মর্ম পশুপাখিও বুঝে। এই দেখেন ছাড়তাছি। সে যাবে না।
মকবুল খাঁচার দরজা খুলে দিল। কাকটা বের হয়ে এসে মকবুলের চারপাশে গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবারো খাঁচায় ঢুকে গেল।
স্যার, আমার জন্যে খাস দিলে দোয়া কইরেন, যেন পিশাচ সাধনা শেষ করতে পারি।
কাক মারতে পারবে?
উপায় কী! মারতে হবে। যে সাধনার যে নিয়ম। দিল শক্ত করার চেষ্টা নিতাছি। হবে, দিল শক্ত হবে। সময় লাগবে। লাগুক। তাড়াহুড়ার তো কিছু নাই। কী বলেন স্যার?
খাঁচার ভেতর থেকে কাক আবারো কা কা করে দু’বার ডাকল। মকবুল বিরক্ত গলায় বলল, খাওন তো দিবরে বাপ। তরে খাওন না দিয়া আমি খাব? তুই আমারে ভাবস কী! চুপ কইরা থাক, স্যারের সাথে মূল্যবান আলাপ করতেছি।
কাক চুপ করে গেল।
আমি তাকিয়ে আছি। অবাক হয়ে এমন একজনকে দেখছি যে হৃদয়ে ভালোবাসার সমুদ্র ধারণ করে পিশাচ হবার সাধনা করে যাচ্ছে।
শাহ্ মকবুল
গল্প আমি সাধারণত এক বৈঠকে লেখার চেষ্টা করি। গল্প আমার কাছে হচ্ছে একটা রঙিন সুতা দিয়ে নকশা তৈরি করা। নকশা তৈরির কাজ কয়েক বৈঠকে করলে নকশার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। শাহ মকবুল গল্প নিয়ে আমি কতবার যে বসেছি তা আল্লাহ মাবুদ জানেন। শেষটায় ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে- গল্পটা ফেলে দিয়েছি।