ছি-ছি! কন কী আপনে? আপনের ক্ষতি হবে এমন কাজ পিশাচ-সাধক মকবুল করব না।
সে আমার পা থেকে এক-দেড় হাত দূরে মাটিতে হাত দিয়ে ভক্তিভরে কদমবুসি করল। কদমবুসির পর দু’হাত জোড় করে চোখবন্ধ অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করল। কে জানে পিশাচ সাধকদের কদমবুসি করার এটাই হয়তো নিয়ম। বিপুল বিশ্বের কতই বা আমি জানি।
তোমার খাঁচায় কী? কাক না-কি?
জি স্যার কাক। আমরা বলি কাউয়া।
তোমার কাকের ব্যাপারটা কী বলো তো?
সাধনার জন্যে লাগে স্যার।
ও আচ্ছা।
গ্রামে বেড়াতে এলে এ জাতীয় যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়। দু’তিন দিনের জন্যে যাই। নানান ধরনের মানুষ এর মধ্যে আসে। মূল উদ্দেশ্য অর্থ ভিক্ষা। সরাসরি ভিক্ষা চাইতে সঙ্কোচ হয় বলেই নানান কিচ্ছা কাহিনীর ভেতর দিয়ে তারা যায়। একবার এক মওলানা সাহেব এসেছিলেন। তাকে নাকি আমাদের নবী-এ-করিম স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছেন– তোর ছেলেকে আমার রওজা মোবারকে এসে দোয়া করে যেতে বল। সে যে দোয়া করবে ইনশাল্লাহ তা-ই কবুল হবে। মওলানা সাহেব এসেছেন ছেলের মদিনা ভ্রমণের টাকা সংগ্রহ করতে।
এসব ক্ষেত্রে আমি কোনো তর্কে যাই না– টাকা দিয়ে দেই। তেমন বেশি কিছু না, সামান্যই। তাতেই তারা খুশি হয়। তাদের প্রত্যাশীও হয়তো অল্পই থাকে।
আমি ঠিক করেছি পিশাচ-সাধককে পঞ্চাশ টাকা দেব। পিশাচ-সাধক যে এই টাকা পেয়েই মহাখুশি হবে সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তার আনন্দ আরো বাড়বে যদি কিছুক্ষণ তার সঙ্গে গল্প করি। আমাদের অঞ্চলের গ্রামের মানুষ অলস প্রকৃতির। অলস মানুষের আনন্দ-বিলাস গল্পগুজব। হাসিমুখে কিছুক্ষণ গল্প করলেই তারা খুশি। আমি গল্প শুরু করলাম।
তুমি তাহলে পিশাচ-সাধক?
জি স্যার।
জ্বীন সাধনার কথা শুনেছি, পিশাচ সাধনার কথা শুনি নি।
পিশাচ সাধনা আরো জটিল। পিশাচ নিয়া কারবার। এরা ভয়ঙ্কর। সাধনাও কঠিন।
এমন ভয়ঙ্কর সাধনার দিকে গেলে কী জন্যে?
মন ঐদিকে টানছে। মনের উপরে তো হাত নাই। কপালগুণে ভালো ওস্তাদও পেয়েছিলাম।
ওস্তাদের নাম কী?
উনার নাম কলিমুল্লাহ দেওয়ানি।
নাম তো জবরদস্ত।
উনি মানুষও জবরদস্ত ছিলেন। আলিশান শরীর। কথা যখন বলতেন মনে হইতো মেঘ ডাকতেছে। এক বৈঠকে দুইটা কাঁঠাল খাইতে পারতেন।
মারা গেছেন না-কি?
জি, উনার ইন্তেকাল হয়েছে। বড়ই দুঃখের মৃত্যু। ঘটনাটা বলব?
বলো।
এক মঙ্গলবার সন্ধ্যাকালে তিনি ঘর থাইক্যা বাইর হইছেন। মনের বেখেয়ালে শরীর বন্ধন দেন নাই। পিশাচ আইসা ধরল। মট কইরা একটা শব্দ হইল। মাথায় মোচড় দিয়া দিল ঘাড় ভাইঙ্গা।
পিশাচ সাধনা দেখি খুবই বিপদজনক ব্যাপার।
বিপদ বলে বিপদ! চিন্তায় চিন্তায় অস্থির থাকি। ভুলভ্রান্তি হইলে বাঁচনের উপায় নাই।
পিশাচ-সাধককে দেখে অবশ্যি আমার মনে হলো না সে কোনোরকম চিন্তায় আছে। তাকে বরং আনন্দিতই মনে হলো।
খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
জি-না, খাওয়া হয় নাই।
খাওয়া-দাওয়াতে কোনো বাছ-বিচার আছে?
জি-না, আমরা সবই খাইতে পারি। তবে টক খাওয়া নিষেধ। টক ছাড়া সবই চলে। মাছ-মাংস-ডিম-দুধ… অসুবিধা কিছু নাই।
আমি মানিব্যাগ খুলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে খুবই আগ্রহের সঙ্গে নোটটা নিল। আবারো কদমবুসি। আবারো হাত জোড় করে চোখবন্ধ অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়ানি। খাঁচায় বন্দি কাকও এইসময় ডানা ঝাপ্টাতে শুরু করল। কফ লাগা গলায় কয়েকবার বলল, কা কা। মোটামুটি রহস্যময় দৃশ্য।
মকবুল বলল, স্যারের সঙ্গে কথা বইল্যা আরাম পাইছি। জমানা খারাপ, মানুষের সাথে কথা বইল্যা এই জমানায় কোনো আরাম নাই। এই জমানা হইল অবিশ্বাসের জমানা। কেউ কারো কথা বিশ্বাস করে না। আমারে নিয়া হাসাহাসি করে। স্যার, আমারে চাইরটা ভাত দেওনের হুকুম দিয়া দেন। আপনে হুকুম না দিলে এরা ভাত দিব না। একবাটি মুড়ি খাওয়াইয়া বিদায় কইরা দিব।
ভালোমতো যাতে খাওয়া-দাওয়া করতে পার সে ব্যবস্থা করছি।
খাওয়া খাদ্য না পাইলেও আমরার স্বভাব-চরিত্রও পিশাচের মতো। তিন চাইর দিন না খাইলেও আমরার কিছু হয় না। আবার ধরেন মরা লাশ পইড়া আছে, প্রয়োজনে লাশের মাংসও খাইতে পারব, অসুবিধা নাই।
খেয়েছ কখনো?
জি-না।
খাও নি কেন?
প্রয়োজন পড়ে নাই। তাছাড়া লাশ পাওয়াও যায় না। হিন্দুরা লাশ পুড়ায়ে ফেলে। মুসলমানরা দেয় করব। করব থাইক্যা লাশ বাইর কইরা খাওয়া বিরাট দিকদারি। ঠিক না স্যার?
ঠিক তো বটেই। তোমার সাধনার ফলাফল কী? পিশাচ বশ মানবে?
অবশ্যই। আমি নিজেও পিশাচের মতো হয়ে যাব। দিলে মায়া-মুহব্বত কিছু থাকব না। ইচ্ছা হইল খুন করলাম, থানা-পুলিশ কিছু করতে পারব না।
খুন করতে ইচ্ছা করে?
জে-না, করে না।
তাহলে এত কষ্ট করে সাধনা করছ কেন? সাধনা করে পিশাচ হবার দরকারইবা কী! আমাদের সমাজে পিশাচের তো অভাবও নেই। সাধনা ছাড়াই অনেক পিশাচ আছে।
কথা সত্য বলেছেন। তবে স্যার ঘটনা হইল পিশাচ সাধনা থাকলে– লোকজন ভয় খায়। সমীহ করে। একজন পিশাচ-সাধকরে কেউ তুই তুকারি করবে না। আপনে আপনে করবে। কারোর বাড়িতে গেলে মাটিতে বসতে হবে না। চিয়ার দিবে। যার চিয়ার নাই সে জলচৌকি দিৰে। মড়ি খাওয়াইয়া বিদায় দিবে না, গরম ভাত দিবে। সালুন দিবে। দিবে কি-না বলেন?