ফুলি মিলিটারির দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, তোমার আর কোনো ভয় নাই। আমার স্বামী তোমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিবে। তুমি এখন চারটা ভাত খাও। মিলিটারি বাংলা ভাষার কী বুঝল কে জানে। সে শুধু বলল, শুকরিয়া বহেজি। লাখো শুকরিয়া।
ফুলি ভাত বেড়ে নিয়ে এলো। তাকে খাওয়াতে বসল। আমাকে বলল, তুমি দেরি করো না– চলে যাও।
আমি ছাতা হাতে বাড়ি থেকে বের হলাম। তখনো ঝুম বৃষ্টি চলছে। তবে বাতাস কমে গেছে। আমি দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছি। কী করা যায়, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। স্ত্রীকে কথা দিয়েছি। আল্লাহ পাকেরকালাম ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি। সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা দরকার। ছেলেটার জন্যে মায়াও লাগছে। বাচ্চা ছেলে। এরা হুকুমের চাকর। উপরওয়ালার হুকুমে চলতে হয়। তাছাড়া বেচারা জীবনই শুরু করে নাই। দেশে ফিরে বিয়ে-শাদি করবে। সুন্দর সংসার হবে। আবার অন্যদিকও আছে। একে মাধবখালি পৌঁছে দিলে ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়বে। নৌকার মাঝিই বলে দিবে। কোনো কিছুই চাপা থাকে না। তারপর রাজাকার হিসাবে আমার বিচার হবে। দেশের মানুষ আমার গায়ে থু দিবে। পাকিস্তানি মিলিটারি শুধু যে আমাদের চরম শত্রু তা না, এরা সাক্ষাৎ শয়তান। এদের কোনো ক্ষমা নাই।
আমি নৌকার খোঁজে গেলাম না। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে খবর দিলাম। রাত দুটার সময় তারা এসে দিলদারকে ধরে নিয়ে গেল। দিলদার আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলল, বহেনজি। তারপরই চুপ করে গেল। আমার স্ত্রী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। দিলদারকে সেই রাতেই গুলি করে মারা হলো। মৃত্যুর আগেও সে কয়েকবার আমার স্ত্রীকে ডাকাল, বহেনজি! বহেনজি!
আমার স্ত্রী মারা গেল সন্তান হতে গিয়ে। একদিক দিয়ে ভালোই হলো। বেঁচে থাকলে সারাজীবন স্বামীকে ঘৃণা করে বাঁচত। সে বাঁচা তো মৃত্যুর চেয়ে খারাপ।
বুঝলেন ভাই সাহেব, যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। যুদ্ধে শুধু পাপের চাষ হয়। আমার মতো সাধারণ একটা মানুষ কতগুলো পাপ করল চিন্তা করে দেখেন। রোজ হাশরে আমার বিচার হবে। আল্লাহ পাক পাপ-পুণ্য কীভাবে বিচার করেন, আমাকে কী শাস্তি দেন এটা আমার দেখার খুব ইচ্ছা।
পিশাচ
পিশাচ গল্পটা আমি একটি সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্যে লিখি। (সাহিত্য পত্রিকা এবং সম্পাদকের নাম ইচ্ছা করেই দিলাম না) ফরমায়েসী লেখা বলা যেতে পারে। সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকরা বিদগ্ধ ব্যক্তি হয়ে থাকেন। তারা সাহিত্যের ভাল-মন্দ, কালজয়ী লেখা, কাল পরাজিত লেখা একবার পড়েই ধরতে পারেন। তাঁরা এক অর্থে সাহিত্যের থার্মোমিটার। এদের কাছে লেখক হিসেবে আমি জাতে উঠি যখন বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় তখন। এম্নিতে আমি তাদের ভাসুর শ্রেণীর। নামও মুখে আনেন না। আকারে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেন যে আমি নিম্নমানের পাঠক ভুলানো লেখা লিখে সাহিত্যের কি ভয়ঙ্কর ক্ষতিই না করছি। এরাই যখন বিশেষ সংখ্যার লেখার জন্যে কুলাকুলি করেন তখন নিষিদ্ধ কর্মের আনন্দের মত আনন্দ পাই।
*
স্যার, আমি পিশাচ সাধনা করি।
আমি কৌতূহল নিয়ে পিশাচ-সাধকের দিকে তাকালাম। মামুলি চেহারা। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় চুল নেই। শরীরের তুলনায় মাথা বেশ ছোট। সেই মাথা শারীরিক কোনো অসুবিধার কারণেই হয়তো সারাক্ষণ বামদিকে ঝুঁকে আছে। তার হাতে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা পাখির খাঁচা। খাঁচায় যে পাখিটা আছে সেটা খুব সম্ভব কাক। পা ছাড়া পাখিটার আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কাকের পা বলেই মনে হচ্ছে।
লোকটার বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। গ্রামের অভাবী মানুষের বয়স চট করে ধরা যায় না। দুঃখ ধান্ধায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরেই তাদের মধ্যে বুড়োটে ভাব চলে আসে। আমার কাছে মনে হলো, লোকটার বয়স চল্লিশের বেশি হবে। মাথার চুল অবশ্যি বেশির ভাগই পাকা। মুখের চামড়াও ঝুলে পড়েছে।
লোকটার পরনে টকটকে লাল রঙের নতুন লুঙ্গি। গলায় একই রঙের লাল চাদর উড়নার মতো ঝোলানো। এটাই সম্ভবত পিশাচ-সাধকদের পোশাক। সব ধরনের সাধকদের জন্যে পোশাক আছে ড্যানসিং দরবেশরা আলখাল্লা পরেন, সন্ন্যাসীরা গেরুয়া পরেন, নাগা সন্ন্যাসীরা নগ্ন থাকেন। পিশাচ সাধকরা লাল লুঙ্গি এবং লাল চাদর কেন পরবে না! আমি পিশাচ-সাধকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, তুমি তাহলে পিশাচের সাধনা কর?
পিশাচ-সাধক সব কয়টা দাঁত বের করে হাসল। আনন্দিত গলায় বলল, কথা সত্য।
লোকটার দাঁত ঝকঝকে সাদা। গ্রামের মানুষরা পান-সিগারেট খেয়ে দাঁত কুৎসিতভাবে নোংরা করে রাখে, এর বেলায় তা হয় নি।
নাম কী তোমার?
মকবুল। স্যার, আমি পিশাচ-সাধক মকবুল। যদি অনুমতি দেন আপনেরে কদমবুসি করি।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, অনুমতি দিলাম।
সে অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, পায়ে হাত দিব না স্যার। ভয়ের কিছু নাই।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, পায়ে হাত দিলে ভয়ের কী?
পিশাচ সাধনা যারা করে তারা কারোর শইল্যে হাত দিলে বিরাট ক্ষতি হয়।
ক্ষতিটা কার হয়–তোমার, না তুমি যার গায়ে হাত দিবে তার?
আমি যার শইল্যে হাত দিব তার। আপনের শইলো হাত দিলে আপনার বিরাট ক্ষতি হইব। যেখানে হাত দিব সেখানে ঘা হইব।
পায়ে হাত দাও। দেখি ক্ষতি কী হয়! ঘা হয় কি-না।