নসিমন বিবি সূরা আর রাহমান পাঠ করতে করতে চেষ্টা শুরু করলেন। তলপেটে চাপ দিয়ে একটা পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতিতে মাঝে মাঝে কাজ হয়। বেশিরভাগ সময়ই হয় না। তারচে’ বড় কথা সন্তানের কোনো নড়াচড়া নেই। সন্তান ইতিমধ্যে মারা গিয়ে থাকলে এই পদ্ধতিতে মায়ের মৃত্যু অবধারিত। নসিমন বিবির মাথা ঘুরতে থাকল। সূরা আর রাহমান পাঠে গণ্ডগোল হয়ে গেল। তিনি সূরা আবার প্রথম থেকে শুরু করলেন। বিশাল জানালা খোলা। খোলা জানালায় বরফের মতো ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। ঘরে দ্বিতীয় কেউ নেই। যে তাকে নিয়ে এসেছিল, সে এই ঘরে ঢুকে নি।
নসিমন বিবি বললেন, কেউ আছ? গরম পানি লাগব?
কেউ জবাব দিল না।
মেয়েটি এখন আর কাতরাচ্ছে না। বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে।
‘আল্লাহপাক, তুমি রহম করো’ বলে তিনি মেয়েটির তলপেটে হাত রাখলেন। তিনি তাঁর নানিজানের শেখানো পদ্ধতি প্রয়োগ করলেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, অতি রূপবান এক পুত্র সন্তানের জন্ম হলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।
নসিমন বিবি বাচ্চাটিকে মা’র পাশে শুইয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
তার যখন জ্ঞান হলো, তখন তিনি ঐ মানুষটার পিঠে। মানুষটা বাতাসের মতো ছুটছে। তার কানের পাশ দিয়ে বরফ ঠাণ্ডা হাওয়া ঝড়ের মতো বইছে। তিনি চলে গেছেন ঘোরের মধ্যে।
মাগো, ঘরে যান।
লোকটি তাকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়েছে। তিনি দরজার সামনে দাঁড়ানো। নিজের পরিচিত বাড়িঘর। লোকটি শান্ত গলায় বলল, মা, আপনি কারো কাছ থেকে কিছু নেন না এটা আমি জানি। কিন্তু আপনাকে একটা জিনিস আমি দেব, এটা আপনাকে নিতে হবে।
বলেই লোকটা দরজার সামনের বড়ুই গাছের ডাল ভাঙল। ডালে কয়েকটা বড়ুই ধরে আছে।
মা কোঁচড় মেলেন।
তিনি কিছু না বুঝেই কেঁচড় মেললেন। তাঁর সামনে যে দাঁড়ানো সে রহস্যময় একজন মানুষ কিংবা অন্য কিছু। এর সঙ্গে তর্কে যাওয়ার কোনই কারণ নেই।
নসিমন বিবি কেঁচড়ে বড়ুইয়ের ডাল নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। কোঁচড় থেকে ডাল ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তাঁর শরীর আর টানছিল না। কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করার মতো মনের অবস্থাও নেই। ঘুমে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া এখন কিছুই করার নেই।
তার ঘুম ভাঙল পরদিন দুপুরে। প্রথমেই চোখ পড়ল বড়ুইয়ের ডালে। রোদের আলো পড়ায় ডালটাকে হলুদ দেখাচ্ছে। হলুদ ডালপালায় হলুদ পাকা বড়ুই। তাঁর বুঝতে অনেক সময় লাগল যে, কোনো ব্যাখ্যাতিত কারণে ভাঙা বড়ুইয়ের ডাল স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়েছে। ডাল সোনার, পাতা সোনার এবং বড়ুইগুলি সোনার।
.
আমি যখন নসিমন বিবির সঙ্গে দেখা করি, তখন তাঁর বয়স সত্তরের উপর। চোখে তেমন দেখেন না। তবে কান পরিষ্কার। কথাবার্তা বলেন ঝনঝন করে।
আমি বললাম, বুড়িমা, এমন কি হতে পারে যে, প্রবল জ্বরের ঘোরে আপনি স্বপ্ন দেখেছেন। সারাজীবন আপনি সন্তান প্রসব করিয়েছেন। কাজেই আপনার স্বপ্নও ছিল সন্তান প্রসব বিষয়ক।
বুড়ি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, হইতেও পারে। বাবা, আপনের কথা ফেলার উপায় নাই। বিবেচনার কথা। কিন্তু বাবা, সোনার বড়ুইয়ের ডালের কথাও সত্যি। বিক্রি কইরা কইরা সংসার চালাইছি। আমার আত্মীয়-স্বজনরা কিছু নিছে। এরা তাবিজের মতো কোমরে পরত। একটা বড়ুই আর একটা পাতা নিয়েছেন ফরিদপুরের ডিসি সাহেবের স্ত্রী। তয় তিনি নগদ টেকায় খরিদ কইরা নিচ্ছেন।
আপনার কাছে কি কিছুই নাই?
একটা পাতা আছে।
আমাকে দেখাবেন?
না।
না কেন?
বিশ ত্রিশ বছর ধইরা এই পাতা দেখাইতেই আছি। দেখাইতেই আছি। আর কত? গত বছর শীতের সময় আপনের মতো এক লোক আসল। পাতার ছবি তুলল। কত সুন্দর সুন্দর কথা বলল। তারপরে বলল, এই পাতা স্যাকরার দোকানে তৈরি। ঠিক আছে বাবা, তৈরি হইলে তৈরি। আমি বললাম, ঠিক আছে।
তারপর সে পাতা কিনতে চায়। বলে তিনগুণ দাম দিব। আমি বেচব না, সে কিনবেই। হাত থাইকা পাতা ছাড়ে না। তার কাছ খাইকা পাতা বাইর করতে অনেক ঝামেলা হইছে। এরপর থাইক্যা ঠিক করছি– কাউরে দেখব না। বাবা, আপনি কিছু মনে নিবেন না।
পাপ
পাপ পুণ্য নিয়ে আমার নিজের কিছু সমস্যা আছে। পাপ কি, পুণ্যইবা কি যা কল্যাণকর তাই কি পুণ্য? যা একজনের জন্যে কল্যাণকর তা অন্যের জন্যে অকল্যাণকর হতে পারে। সেখানে পাপ পুণ্য কিভাবে আলাদা করব। আমি পাপ এবং পণ্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় অনেক গল্প লিখেছি। এর মধ্যে একটি গল্প ‘পাপ’ আমার খুব পছন্দের। পাঠকদের জন্যে পাপ বিষয়ক তিনটি গল্প দিয়ে দিলাম। পাপ, হাজি মান্না মিয়া, সালাম সাহেবের পাপ। এর মধ্যে পাপ শিরোনামের গল্পটি পুরাতন সংকলনে একটি পুরানো গল্প চুকিয়ে দেবার অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি। আমার উদ্দেশ্য খারাপ না কিন্তু। পাঠকদের আমার চিন্তার জগৎ সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়া।
পাপ বিষয়ে Hitaire Belloe এর একটি লেখা আছে। লেখাটি উদ্ধৃত করবার লোভ সামলাতে পারছি না।
When I am dead
I hope it may be said
“His sins were scarlet, but his books were recal.”
আমি যখন মারা যাব
আশা করি তখন বলা হবে–
লোকটির পাপগুলো ছিল রঙিন, কিন্তু তার বইগুলো পঠিত হয়েছিল।
*
ভাই আপনাকে একটা ভয়ঙ্কর পাপের গল্প বলি। পাপটা আমি করেছিলাম। নিজের ইচ্ছায় করি নি। স্ত্রীর কারণে করেছিলাম। স্ত্রীদের কারণে অনেক পাপ পৃথিবীতে হয়েছে। মানুষের আদি পাপও বিবি হাওয়ার কারণে হয়েছিল। আপনাকে এই সব কথা বলা অর্থহীন। আপনি জ্ঞানী মানুষ, আদি পাপের গল্প আপনি জানবেন না তো কে জানবে। যাই হোক মূল গল্পটা বলি।