গ্রামাঞ্চলে ধাত্রীদের সামাজিক অবস্থান অতি নিচে। সন্তানের জন্মের বিষয়টা সেই সময় গ্রামে নোংরা বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতো। সন্তানের জন্মের জন্যে মূল বাড়ির চেয়ে একটু দূরে আঁতুড়ঘর বলে একটা ঘর তৈরি হতো। সেই ঘর চল্লিশ দিন পর ভেঙে দেয়া হতো বা পুড়িয়ে দেয়া হতো। সন্তানের জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত ধাত্রীকে সেই কারণেই নোংরা ভাবা হতো।
তারা থাকতও নোংরাভাবে। ময়লা শাড়ি-কাপড়, মুখভর্তি পান। এরা আসতও অতি দরিদ্র পরিবার থেকে। ভদ্রঘরের কোনো মেয়ে এই কাজ করত না। সন্তানের জন্মের পর তারা একটা শাড়ি পেত, এক ধামা চাল পেত। ছেলে সন্তান হলে বাড়তি পাঁচ দশটা টাকা পেত।
নসিমন বিবি ছিলেন ভদ্রঘরের মেয়ে। খুব সম্ভব ধাত্রীর কাজটা তিনি সমাজসেবা হিসেবে করতেন। কারণ কাজটা করে তিনি কখনো কারো কাছ থেকে কোনো অর্থ বা উপহার নেন নি। সবার সামনে শাড়ি নিতে তিনি লজ্জা পাচ্ছেন ভেবে কেউ কেউ গোপনেও তাঁর কাছে শাড়ি পাঠিয়েছে। তিনি ফেরত দিয়েছেন।
অনেক দূর দূর থেকে তার কাছে লোকজন আসত। কখনো তিনি দূরের পথ বলে কাউকে ফিরিয়ে দেন নি। পাস করা ডাক্তার তখন যে একেবারে ছিল না, তা-না। শহরে-গঞ্জে ছিল। গ্রামের মানুষ পুরুষ ডাক্তারদের এই কাজে ব্যবহার করবে তা কল্পনাও করত না।
নসিমন বিবির বয়স যখন চল্লিশ, তখন তাঁর স্বামী মারা যান সাপের কামড়ে। নসিমন বিবির মাথায় আক্ষরিক অর্থেই আকাশ ভেঙে পড়ল। তার কষ্টের জীবন শুরু হয়। অল্প সম্পত্তি। ভাগীদাররা ভাগের অংশ ঠিক মতো দেয় না। আম-কাঁঠালের একটা বাগান ছিল। সে বাগান বেদখল হয়ে যায়। অবস্থা এমন হলো যে, তিনি দু’বেলা খেতে পারেন না।
এই চরম বিপর্যয়ের সময়েও তিনি আগের নীতি বহাল রাখেন। সন্তান প্রসব করাবেন কিন্তু বিনিময়ে কিছু নেবেন না।
পৌষ মাসের মাঝামাঝি। হাড় কাঁপানো শীত পড়েছে। শীতের সঙ্গে ঘন কুয়াশা। এমন কুয়াশা যে, এক হাত সামনের কিছুও দেখা যায় না। নসিমন বিবির জ্বর। এমন জ্বর যে, বিছানা থেকে নেমে এক গ্লাস পানি খাবেন সেই সামর্থ্যও নেই। তিনি গায়ে একটা কম্বল এবং দু’টা কথা দিয়ে থরথর করে কাঁপছেন। শীত মানছে না। রাত কত তিনি জানেন না। জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। এমন সময় দরজায় ধাক্কা পড়ল। একজন পুরুষ মানুষ কাতর গলায় বলল, মাগো, আমার বড় বিপদ। আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।
নসিমন বিবি বললেন, জ্বরে আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। বাবা, আমার পক্ষে বিছানা থেকে নামাই অসম্ভব।
পুরুষ কণ্ঠ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি জীবনে কাউকে ফিরিয়ে দেন নাই। আমার বিপদের সীমা নাই মা। দয়া করেন। সামান্য দয়া।
নসিমন বিবি বলেন, দয়া করার ক্ষমতা আমার নাই। দয়ার মালিক আল্লাহপাক।
বলতে বলতে তিনি বিছানা থেকে নামলেন। গায়ে কম্বল জড়িয়ে দরজা খুললেন। অন্ধকারে চাদর মুড়ি দিয়ে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি তাকে দেখেই বলল, চলেন মা চলেন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নসিমন বিবি নিজের শরীর সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সামনের মানুষটাকে অনুসরণ করছেন। চাদর গায়ে মানুষটা আগে আগে যাচ্ছে। তার হাতে না আছে টর্চ, না আছে লণ্ঠন। ঘন কুয়াশায় চারদিকে ঢাকা। তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কোনদিকে যাচ্ছেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না। নসিমন বিবি বলেন, আমি আর হাঁটতে পারতেছি না। এখন আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাব। কথা শেষ করার আগেই তিনি রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। লোকটি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। সে ছুটে এসে বলল, আমি আপনাকে মা ডেকেছি। আমি আপনার ছেলে। ছেলে যদি মা’কে ঘাড়ে তুলে নেয় তাতে কোনো দোষ নেই।
বলেই লোকটা নসিমন বিবিকে তার পিঠে তুলে নিল। এখন লোকটি আর হাঁটছে না, দৌড়াচ্ছে।
এই পর্যায়ে নসিমন বিবি ভয় পেয়ে গেলেন। তার হঠাৎ মনে হলো কোনো মানুষের পক্ষে এইভাবে দৌড়ানো সম্ভব না। তাছাড়া তিনি আশপাশে কোনো ঘরবাড়ি দেখছেন না। গাছপালা দেখছেন না। মনে হচ্ছে লোকটা যেন আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটছে। নসিমন বিবি বললেন, বাবা, তুমি কে?
লোকটা বলল, মা, ভয় পাবেন না। আপনাকে মা ডেকেছি। আমি আপনার ছেলে।
নসিমন বিবি বললেন, কত দূর।
এই তো এসে পড়েছি। চোখ বন্ধ করে থাকেন মা। চোখ বন্ধ করে থাকেন।
প্রচণ্ড আতঙ্কে নসিমন বিবি চোখ বন্ধ করলেন।
যখন তিনি চোখ খুললেন, তখন তিনি একটা পুরনো আমলের দালানের ভেতরের একটা কোঠায় দাঁড়ানো। তার সামনে রেলিং দেয়া পুরনো আমলের পালংক। পালংকে একটি ষোল সতেরো বছরে মেয়ে প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। নসিমন কিছুক্ষণ অভিভূত চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি তাঁর দীর্ঘজীবনে এরকম রূপবতী মেয়ে দেখেন নি। মনে হচ্ছে মেয়েটির শরীর রক্ত-মাংসের তৈরি না, মোমের তৈরি।
আশ্চর্যের ব্যাপার ঘরে কোনো আলো নেই। মেয়েটির শরীরের আলোতেই ঘর আলো হয়ে আছে।
নসিমন বিবি বললেন, মাগো, তোমার নাম কী?
মেয়েটি কাতরাতে কাতরাতে বলল, আমার কোনো নাম নাই। আপনি আমার সন্তানটাকে বাঁচান।
নসিমন বিবি কাজ শুরু করেই থমকে গেলেন। সন্তানের অবস্থান ঠিক না। মাথা উল্টা। মেয়েটাকে সদর হাসপাতালে নেয়া দরকার। ডাক্তাররা ছুরি কাচি দিয়ে যদি কিছু করতে পারেন। মেয়েটা যেন তার মনের কথা বুঝে ফেলল। সে হতাশ গলায় বলল, যা করার আপনাকেই করতে হবে।