সে নূপুর পায়ে দিয়ে হাঁটবে। ঝুমঝুম হাঁটবে। ভাবতেও ভালো লাগছে। আয়না যদি নূপুর পায়ে নাও দেয়, নাফিসা দেবে। সেটাও তো খারাপ না।
স্যার আমি নাফিসার নামও দিয়েছি আয়না। ভালো করেছি না? একজন রিয়েল সংখ্যা অন্যজন ইমাজিনারি সংখ্যা।
নাফিসা x হলে আয়না √ (-1) x
নসিমন বিবি
গায়ক এস আই টুটুল শুধু যে চমৎকার গান করে তা না, সুন্দর করে গল্পও বলতে পারে। তার গল্প বলার স্টাইলে মুগ্ধ হয়ে আমি প্রায়ই নাটকে অভিনয় করতে ডাকি। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ক্যামেরার সামনে সে মোটেই স্বচ্ছন্দ না। ডায়ালগও মনে রাখতে পারে না। যাই হোক কি এক নাটকে মনে হয় ‘চন্দ্র কারিগর’ সে অভিনয় করতে এসেছে। স্যুটিং এর শেষে গল্পগুজব হচ্ছে। টুটুল শুরু করল ভূতের গল্প। নসিমন বিবি হল সেই গল্প। টুটুলের দাবি নসিমন বিবিকে সে দেখেছে। এবং নসিমন বিবির সংগ্রহের স্বর্ণ বড়ুই পাতাও দেখেছে।
আদিভৌতিক ব্যাপারে টুটুলের খুব উৎসাহ। একবার আমার ধানমন্ডির বাড়িতে সে দুই সাধককে নিয়ে এল। তাদের জ্বীনের সাধনা। ভরপেট গরুর মাংস খেয়ে এরা জ্বীনকে আহ্বান করে। জ্বীন এসে ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান হড় হড় করে বলে দেয়। গরুর মাংসের সঙ্গে জ্বীনের কি সম্পর্ক কে জানে। আমি এই দুই সাধককে গরুর মাংস খেয়ে জ্বীন নামাতে বললাম।
পাঠক নিশ্চয়ই ফলাফল জানতে আগ্রহী। ফলাফল হচ্ছে আমি টুটুলকে বললাম তুমি এই দুই মহান সাধককে কানে ধরে উঠ বোস করাও। টুটুল এই কাজ দায়িত্বের সঙ্গে পালন করেছিল।
*
গল্পের নাম দেখে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন না। এই নামের সঙ্গে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া (রিয়াজের হাস্যকর অভিনয় সমৃদ্ধ) ছবি নসিমনের কোনো যোগ নেই। নসিমন আমার নোটবুকে লেখা একটা নাম।
একসময় পশ্চিমা লেখকদের মতো আমি একটা মোটা নোট বই সঙ্গে রাখতাম। বিস্ময়কর কিছু দেখলে লিখে ফেলতাম। ডায়েরি ধরনের লেখা না, শর্টহ্যান্ড জাতীয় লেখা। উদাহরণ দেই। নসিমন বিবি’র ব্যাপারটা এইভাবে লেখা–
নসিমন বিবি
বয়স : প্রায় সত্তর
পেশা : ধাত্রী।
বিষয় : বড়ুইপাতা।
ঠিকানা : …
আমার স্মৃতিশক্তি ভালো ছিল (কেমিস্ট্রির ছাত্রদের ভালো স্মৃতিশক্তি বাধ্যতামূলক)। নোটবুকে টুকে রাখা শর্টহ্যান্ড জাতীয় লেখা পড়ে পুরো বিষয় মনে পড়বে এমন ভরসা বরাবরই ছিল। ইদানীং মনে পড়ছে না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি exponentially নেমে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। নোটবুকে টুকে রাখা অনেক লেখা পড়ে আগামাথা কিছুই পারছি না। এক জায়গায় লেখা–
কলাগাছ
বেঁটে। কলা হয় না।
বিষয় : কাঠঠোকরা পাখি (দুইটি)
অনেক চিন্তা করলাম এর মানে কী? কাঠঠোকরা পাখি কি কলাগাছের মতো নরম গাছে বাসা বেঁধেছে? কিছুই মনে পড়ল না।
আরেক জায়গায় লেখা–
পদ্মদিঘি
Crystal clear water
বিষয় : লাল রঙ
এর মানে কী? এমন কোনো পদ্মদিঘি কি দেখেছি যার রঙ লাল। লাল রঙের দিঘি এমন কোনো বিস্ময়কর বিষয় না। লাল রঙের শৈবাল পানিকে লাল করে দেয়। নুহাশ পল্লীর দিঘিও মাঝে মাঝে লাল হয়। তাছাড়া শুরুতেই লেখা Crystal clear water–স্ফটিক স্বচ্ছ জল। সেই জল লাল হতে পারে না। তাহলে ঘটনাটা কী?
একসময় জানতাম। এখন জানি না। স্মৃতির উপর এত ভরসা করা ভুল হয়েছে। খুঁটিনাটি সব লিখে রাখা দরকার ছিল।
পশ্চিমা লেখকদের আদলে নিজেকে গোছানোর একটা শখ আমার বরাবরই ছিল। তারা লেখার খাতিরে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াতেন। অভিজ্ঞতার সুটকেস সঙ্গে রাখতেন। অভিজ্ঞতা দিয়ে স্যুটকেস ভর্তি করতেন। কাজেই আমি ১৪ সিটের বিশাল এক মাইক্রোবাস কিনে ফেললাম। এই বাস নিয়ে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এমন কম জায়গা আছে, যেখানে আমি যাই নি।
হয়তো খবর পাওয়া গেল, ফরিদপুরের অমুক গ্রামে এক পীর সাহেব আছেন, যার গা থেকে অসময়ের ফুলের গন্ধ বের হয়, যিনি ভয়ঙ্কর আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন। গাড়িভর্তি লোকজন নিয়ে চলে গেলাম পীর সাহেবের গায়ের গন্ধ শুঁকতে। পীর সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের পর নোটবুকে লিখলাম–
গন্ধপীর
বয়স : পঞ্চাশ।
বিষয় : গায়ে অসময়ের ফুলের গন্ধ।
মন্তব্য : বোগাস।
নোটবই রাখার কারণ অবসর সময়ে নোট বই দেখে গল্প লেখা। যে কাজটি এখন করতে বসেছি। নসিমন বিবিকে নিয়ে গল্প লিখছি। এটি একটি অতিপ্রাকৃত গল্প। সহজ বাংলায় ভূতের গল্প।
ভূতের গল্প বললেই মনে হবে শিশুতোষ গল্প। যে কারণে অতিপ্রাকৃত গল্প বলছি। যাতে পাঠক বুঝতে পারেন এটা শিশুতোষ গল্প না।
আমি ভূত-প্রেত বিশ্বাস করি না। তারপরেও এক গাদা ভূতের গল্প লিখেছি। এর মধ্যে কিছু বানানো। কিছু অর্ধ সত্য, আবার কিছু সত্য।
সত্যি ভূতের গল্প বলছি বলেই পাঠক ধরে নেবেন না যে, আমি আপনাদের ভূত-প্রেত বিশ্বাস করতে বলছি। কখনোই না। গল্প ঠিকমতো ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না বলেই ভৌতিক রূপ নিয়েছে।
যে-কোনো ভয়ঙ্কর ভূতের গল্পকে মিসির আলির কাছে নিয়ে গেলে তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দেবেন ভূত বলে কিছু নেই। সবই ব্যাখ্যার অধীন। সমস্যা হচ্ছে আমাদের সমাজে মিসির আলির সংখ্যা অতি নগণ্য।
যাই হোক, মূল গল্পে চলে যাই।
আজ থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। চল্লিশও হতে পারে। ফরিদপুর জেলার একটি গ্রাম। সেই গ্রামে নসিমন বিবির নিবাস। বয়স পঁচিশ। স্বামী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নিঃসন্তান দম্পতি। সন্তান নেয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন। কোনো চেষ্টাতে ফল হয় নি। স্বামী-স্ত্রীর ভেতর বনিবনা ভালো না। সন্তানহীনাদের স্বামীরা সুনজরে দেখেন না, এই কারণ তো আছেই। তারচে’ বড় কারণ নসিমন বিবির পেশা ধাত্রীগিরি।