আয়নাকে দেখামাত্র আমি বলি—’আয়না কী খবর? আজ আসতে দেরি করছ কেন? বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বুঝতে পারছ? বৃষ্টিতে ভিজবে? চলো ভিজে আসি। তবে একটা কথা, তোমাকে নেংটো অবস্থায় আমি ছাদে নেব না। কাপড়টা গায়ে দাও তারপর নিয়ে যাব। আলমারি খোলার জন্যে এত চেষ্টা করতে হবে না। আমি একটা চাবিওয়ালা এনে আলমারি খোলার ব্যবস্থা করব। পরেরবার যখন আসবে দেখবে আলমারি খোলা। ঠিক আছে? খুশি?’
তালা খোলার লোক আমি ঠিকই নিয়ে এসেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো তালা খুললে মেয়েটা যদি আর না আসে? সে এখানে আসে তো শুধু তালা খোলার অগ্রহে। তালাওয়াকে ফেরত পাঠালাম।
.
স্যার, আমি মেয়েটার সঙ্গে অনেক রহস্যও করি।
একদিন কী করলাম শুনুন। আয়নাটা কালো কাগজ দিয়ে স্কচটেপ মেরে ঢেকে দিলাম। সেদিন বেচারি খুবই অবাক হলো। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। যেন কিছু বুঝতে পারছে না। তখন আমি নিজেই উঠে টেনে কালো কাগজটা খুললাম। বেচারি শান্ত হলো।
আরেকদিন কী করেছি শুনুন। তার জন্যে একটা শাড়ি কিনে এনে টেবিলে রেখে দিয়েছি। সে অবাক হয়ে শাড়িটা হাতে নিয়ে দেখেছে। এদিক-ওদিক দেখেছে। ভাবটা এরকম যে সে ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না।
একবার এক সেন্টের একটি শিশি রাখলাম। সে গন্ধ শুকল, এদিক ওদিক তাকাল। তার মধ্যে হতভম্ব ভাব লক্ষ করলাম।
সারারাত আমি জেগে থাকি ঘুমাতে যাই ভোরবেলায়। ঘুমের মধ্যে মেয়েটাকে স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নে তার সঙ্গে অনেক কথা হয়। স্বপ্নে তার গলার স্বর থাকে কিশোরী মেয়েদের মতো। স্বপ্নে সে আমাকে গান শোনায়, নাচ দেখায়।
আমার শরীর দ্রুত খারাপ করতে লাগল, একদিন বস আমাকে ডেকে পাঠালেন। ধমক দিয়ে বললেন, কী ঘটনা? কী অসুখ?
আমি বললাম, স্যার ঘুম হয় না।
ঘুম হয় না এটা আবার কেমন অসুখ? ডাক্তারের কাছে যাও। ঘুমের ট্যাবলেট দিবে।
আমি বললাম, জি আচ্ছা বস।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছ খবর পেয়েছি, ক্লাসে তো যাও না।
ক্লাস শুরু হয় নাই।
টাকা-পয়সা লাগবে? লাগলে প্রেসের ম্যানেজারের কাছ থেকে নাও। পরে শোধ দিও।
আমি প্রেসের ম্যানেজারের কাছ থেকে পাঁচশ’ টাকা নিলাম, সেই টাকায় আয়নার জন্যে রুপার একজোড়া কানের দুল কিনলাম।
অবাক কাণ্ড কী জানেন স্যার? রুপার কানের দুল কিছুক্ষণের জন্যে আয়না পরেছিল। এই দৃশ্য দেখে আনন্দে আমার চোখে পানি এসেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার মাথা খারাপ হতে শুরু করেছে। শরীরে বিকার দেখা দিয়েছে। মিজান ভাইয়ের পরামর্শ মতো বিকার কাটাতে আজেবাজে মেয়েদের কাছে যেতে শুরু করেছি। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়েছে। আমি ক্লাসে যাচ্ছি না। কীভাবে যাবি? সারারাত জেগে থাকি, সারাদিন ঘুমাই।
শরীরের বিকার কাটাতে প্রতি সপ্তাহে একবার মিজান ভাইয়ের সঙ্গে ‘প্রেস কোয়ার্টারে’ যাই। আমার মোটেও খারাপ লাগে না। যে মেয়েটার কাছে আমি যাই, তার নাম নাসিমা। মেয়েটার বয়স অল্প। চোখে মায়া আছে। আমি আয়নার জন্যে যেসব জিনিস কিনি, আয়নাকে দেখানোর পর সব নাসিমাকে দেই। উপহার পেলে সে খুব খুশি হয়।
একদিন মোহিত স্যার আমার খোঁজে চলে এলেন। তিনি আমাকে দেখে হতভম্ব। তোমার এ কী অবস্থা! কী অসুখ বলো তো।
আমি মিথ্যা করে বললাম, স্যার আমার জণ্ডিস হয়েছে। খারাপ ধরনের জণ্ডিস।
স্যার বললেন, সে তো বুঝতেই পারছি– চোখ হলুদ, হাত-পা হলুদ। তোমাকে ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। দাঁড়াও অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করি।
আমি বললাম, ব্যবস্থা করতে হবে না স্যার। আমার বাবা কাল ভোরে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন।
স্যার বললেন, তুমি তো আমাকে বলেছিলে বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই।
আমি বললাম, মিথ্যা কথা বলেছিলাম স্যার। বাবা বেঁচে আছেন। তিনি অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করেছেন বলে আমি সবাইকে বলি বাবা মারা গেছেন।
স্যার বললেন, বাবার সঙ্গে চলে গেলে তো চিকিৎসা হবে না। তোমার দরকার প্রপার মেডিকেল কেয়ার।
আমি বললাম, (পুরোটাই মিথ্যা) আমার বাবা একজন ডাক্তার। এমবিবিএস ডাক্তার। খুব ভালো ডাক্তার।
মোহিত স্যার চলে গেলেন। তার লেখা ‘কোয়ান্টাম জগৎ’ বইটা প্রকাশিত হয়েছে। তার একটা কপি আমাকে দিলেন। বইয়ে লিখলেন–
‘দৌলত শাহকে
আমার দেখা সবচে’ মেধাবী একজন।’
বইটার সঙ্গে এক হাজার টাকাও দিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই টাকায় আয়নার জন্য রাজশাহী সিল্কের একটা শাড়ি কিনলাম। আমার ধারণা কোনো একদিন আমার দেয়া শাড়ি সে পরবে। আমার সঙ্গে কথা বলা শুরু করবে।
মোহিত স্যার তার বইয়ে প্যারালাল জগতের কথা লিখেছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলছে, আমাদের এই জগতের পাশাপাশি ইনফিনিটি প্যারালাল জগৎ আছে। সব জগৎ একসঙ্গে প্রবহমান। একটি জগতের সঙ্গে অন্য জগতের কোনোই যোগাযোগ নেই।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আয়না অন্য কোয়ান্টাম জগতের বাসিন্দা। কোনো এক বিচিত্র কারণে তার জগতের খানিকটা ঢুকে গেছে এই পৃথিবীর জগতে। কিংবা আরো জটিল কিছু। যে জটিলতা ব্যাখ্যা করার সাধ্য এই মুহূর্তে আমাদের নেই। আমাদের কাজ শুধু দেখে যাওয়া। একদিন রহস্যভেদ হবে, তার জন্য অপেক্ষা করা।
স্যার, আপনি লেখক মানুষ। সত্যিকার লেখক হলেন, একজন আদর্শ Ovserver. যিনি দেখেন, কোনো ঘটনা অবিশ্বাস করেন না, আবার বিশ্বাসও করেন না। তিনি অনুসন্ধান করেন absolute truth. স্যার আমি এখন যাব। আয়নার জন্য একজোড়া রূপার নূপুর কিনেছি। হাতে নিয়ে একটু দেখবেন।