খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরে ফিরে আমি অবাক। একশ’ পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। ঘরে দিনের মতো আলো। বিছানার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। ঘরে বাতাসের বন্যা। সামসু বলল, কাইল রাইতে ঘুমাইতে পারেন নাই, আইজ নাক ডাকায়া ঘুমাইবেন।
আমি বললাম, ফ্যান থেকে তো জাহাজের মেশিন ঘরের মতো শব্দ আসছে।
সামসু বলল, আসুক। শব্দ কোনো বিষয় না। গরমটা বিষয়।
আমি বিছানায় শুয়ে বই নিয়ে পড়তে বসেছি। Hole in the Universe. নামটা যত সুন্দর বই তত সুন্দর না। লেখক কারণ ছাড়াই রহস্য করছেন। কথায় কথায় বাইবেল টেনে আনছেন। জটিল বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ধর্ম মিশিয়ে যে বস্তু তৈরি হচ্ছে তার নাম জগাখিচুড়ি।
ভালো কথা স্যার, জগাখিচুড়ি শব্দটা কোত্থেকে এসেছে জানেন? পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ভক্তদের দেয়া চাল-ডাল মিশিয়ে এক ধরনের খিচুড়ি তৈরি হতো। তার নাম জগন্নাথের খিচুড়ি। সেখান থেকে এসেছে জগাখিচুড়ি।
যে গল্পটা আপনাকে বলছি তার সঙ্গে জগাখিচুড়ি নামের ব্যাখ্যার কোনো সম্পর্ক নেই। তবু বললাম যাতে আপনার বিশ্বাস হয় আমি পড়াশোনা করা ছেলে। গ্রামের কলেজ থেকে আসা হাবাগোবা ভালো ছাত্র না।
মূল গল্পে ফিরে যাই–আমি বই পড়ছি কিন্তু বইয়ে মন দিতে পারছি না। গত রাতে দেখা মেয়েটা কি আজো আসবে। তার গায়ে কি ঐদিনের পোশাক থাকবে? গত রাতে সে যা করেছে আজো কি তাই করবে। আলমারির তালা খোলার চেষ্টা করবে? বেশির ভাগ ভূতের গল্পে দেখা যায় ভূত-প্রেত রাতের পর রাত একই কাণ্ড করে। যে ভুতুকে দেখা যায় সিলিং ফ্যান থেকে গলায় দড়ি দিয়ে বুলিছে, তাকে সেই অবস্থাতেই সবসময় দেখা যায়।
রাত বারোটা পর্যন্ত বই পড়লাম, মেয়েটা এলো না। ঘরে একশ ওয়াটের বাতি জ্বলছে, এই কারণে কি আসতে পারছে না? আমি বাতি নিভিয়ে দিলাম। অন্ধকার ঘরে টেবিলের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করলাম। মেয়েটার দেখা নেই। তখন মনে হলো, ঘরটা কবরের মতো অন্ধকার। এই অন্ধকারে মেয়েটাকে দেখব কীভাবে? হারিকেন জ্বালিয়ে টেবিলের উপর রেখে অপেক্ষা শুরু করলাম। অপেক্ষার নিজস্ব ক্লান্তি আছে। সেই ক্লান্তিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল গুনগুন শব্দে। কে যেন গান করছে। চমকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা এসেছে। তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে। গুনগুন শব্দে এবং নিজের সুরেই সামান্য দুলছে।
স্যার, এখন একটা কথা বলব বেয়াদবি নিবেন না। আমি বয়সে আপনার ছেলের চেয়েও ছোট হব।
বাপের বয়সী একজন মানুষের সঙ্গে এ ধরনের কথা বলা যায় না। কিন্তু আমি ঠিক করেছি কিছুই গোপন করব না। যা দেখেছি সবই আপনাকে বলব।
মেয়েটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। কী সুন্দর যে তাকে দেখাচ্ছিল! লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না আবার চোখও ফিরিয়ে নিতে পারছিলাম না। তার গায়ের পোশাকটা টেবিলের উপর রাখা। সে একসময় পোশাকটা পরল। গত রাতে ওড়না ছিল না। আজ দেখি ওড়না আছে। লাল রঙের ওড়না। ওড়নাটা সে মাথায় দিয়েছে। লাল ওড়নার ভেতর একটা মুখ। বড় বড় চোখ। গোলাপি ঠোঁট। আমি বললাম, এই মেয়ে তুমি কে? তোমার নাম কী?
মেয়েটার কোনো ভাবান্তর হলো না। সে চাবির গোছা হাতে এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। গত রাতের মতো তালা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। আমি বিছানা থেকে নামলাম। হারিকেনটা হাতে নিলাম। তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে কিছুই বুঝল না। আমি বললাম, আলমারিতে কী আছে? তুমি কী খোঁজ? মেয়েটা নির্বিকার। তার ভুবনে আমার কোনো অস্তিত্ব নাই। হারিকেনের তেল শেষ হয়ে গিয়েছিল। দপ করে নিভে গেল। ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত আমি বিছানায় বসে রইলাম।
এত বড় একটা ঘটনা–কাউকে তো বলতে হবে। মিজান ভাইকে বললাম। তিনি আগ্রহ নিয়ে শুনলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যা দিয়ে দিলেন।
মিজান ভাই বললেন, জুয়ান বয়সে সুন্দরী নেংটা মেয়ে দেখা স্বাভাবিক ব্যাপার। এই বয়সে সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে সেক্স হচ্ছে এমন স্বপ্ন দেখে। তখন স্বপ্নদোষ হয়। আমার একটা বই আছে, নাম– স্বপ্নের কাম কাহিনী। বইটাতে স্বপ্নের সেক্স বিস্তারিতভাবে লিখেছি। পড়লেই সব বুঝবে।
আমি বললাম, ও আচ্ছা।
মিজান ভাই বললেন, শরীর খুব বেশি চড়ে গেলে আমাকে বলবে আমি ব্যবস্থা নিব।
কী ব্যবস্থা নিবেন?
শরীর ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করব। তোমাকে প্রেস কোয়ার্টারে নিয়ে যাব। পনের দিনে একবার গেলেই শরীর দিঘির পানির মতো ঠাণ্ডা থাকবে। ভালো কিছু অল্পবয়েসী মেয়ে আছে আমার পরিচিত। ওদের বলে দেব। টাকা পয়সা যাতে নামমাত্র লাগে সেটা আমি দেখব। তোমাকে অত্যধিক স্নেহ করি বলেই এটা করব।
আমাকে অত্যধিক স্নেহ করা শুরু করলেন প্রফেসর মোহিত হাওলাদার। তার স্নেহ পাওয়ার কারণ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট হয়েছি। যেকোনো সাবজেক্ট পড়তে পারি। আমি নিয়েছি ফিজিক্স।
মোহিত স্যার আমাকে বলেছেন, প্রথম এক বছর তুমি হোস্টেলে সিট পারে না। এক কাজ করো, আমার বাড়িতে এসে ওঠ। গেস্ট রুমটা নিজের মতো গুছিয়ে নাও। খাবে আমার এখানে, আমি যা খাই তাই খাবে।
স্যারের গেস্ট রুমটা চমৎকার। সেখানে শুধু ফ্যান না, এসি পর্যন্ত আছে। আমি স্যারের সঙ্গে থাকতে এলাম না। কারণটা খুব পরিষ্কার। আমার পক্ষে গুদামঘর ছেড়ে আসা মানে মেয়েটাকে ছেড়ে আসা। সেটা সম্ভব না। আমি মেয়েটার একটা নাম দিয়েছি—‘আয়না’। সে আয়নায় অনেকক্ষণ নিজেকে দেখে বলেই তার নাম আয়না। যতক্ষণ আয়না থাকে ততক্ষণই আমি নিজের মনে বকবক করি। আয়না আমার কথা শুনতে পায় না। তাতে কী আছে?