আমি বই পড়তে শুরু করেছি। The curious incident নামের বইটা পড়তে শুরু করেছি। অদ্ভুত বই। ফার্স্ট চ্যাপ্টার নেই, শুরু হয়েছে সেকেন্ড চ্যাপ্টার থেকে। প্রথম লাইন–
It was seven minutes after midnight.
আমি নিজের ঘড়ি দেখলাম। কী আশ্চর্য, আমার ঘড়িতেও বারোটা সাত। কাকতালীয় ব্যাপার তো বটেই। মাঝে মাঝে কাকতালীয় ব্যাপারগুলো এমন হয় যে বুকে ধাক্কার মতো লাগে।
অল্প সময়ের ভেতরেই বইয়ের ভেতরে ঢুকে গেলাম। পানির তৃষ্ণা পেয়েছে অথচ পানি খাবার জন্য বই পড়া বন্ধ রেখে যে টেবিলের কাছে যাব সেই ইচ্ছাও হচ্ছে না। গরমে আমার গা দিয়ে ঘাম পড়ছে। ঘামে বিছানার চাদর ভিজে গেছে আমার লক্ষই নেই। প্রবল তুষ্ণার কারণে আমি এক সময়ে বই বন্ধ করে টেবিলের দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণের জন্য আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে অল্পবয়সী এক মেয়ে। সে গভীর আগ্রহে নিজেকে দেখছে। আমি এরকম সুন্দর মেয়ে আমার জীবনে কখনো দেখিনি। মেয়েটার গায়ে ঘাগরা জাতীয় পোশাক। পোশাকের রঙ হালকা কমলা। সেখানে ছোট ছোট আয়না বসানো। হারিকেনের আলো সেই আলোয় পড়ে চারদিকে প্রতিফলিত হচ্ছে। ঘরময় ছোট ছোট আলোর বিন্দু। মেয়েটির চুল বেণি করা। বেণিতে কমলা রঙের ফিতা। তার মুখ লম্বাটে। নাক খানিকটা চাপা। নাকে নাকফুল আছে। সেই নাকফুলও হারিকেনের আলোয় ঝলমল করছে। নিশ্চয়ই দামি কোনো পাথরের নাকফুল। কমদামি পাথর এভাবে আলো ছড়ায় না।
আমি ‘কে কে’ বলে চিৎকার করে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলালাম। কারণ ততক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেছে এটা একটা স্বপ্নদৃশ্য। বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছি, স্বপ্ন দেখছি। চিৎকার চেঁচামেচি না করে স্বপ্নটা ভালোমতো দেখা যাক।
স্যার! আমি যা দেখছি তা যে সত্যিই দেখছি স্বপ্নও দেখছি না তা তখন বুঝিনি। স্বপ্ন সাদাকালো হয় এবং স্বপ্ন হয় গন্ধবিহীন। আমি সব রঙিন দেখছি এবং মেয়েটার গা থেকে আতর কিংবা সেন্টের মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি।
আয়নার উপর দিয়ে একসময় একটা টিকটিকি দৌড়ে গেল। মেয়েটা সামান্য চমকালো। এ ধরনের ডিটেলও স্বপ্নে থাকে না। স্বপ্নে যদি কেউ টিকটিকি দেখে তখন সেই টিকটিকি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে আসে।
মেয়েটা আয়নায় নিজেকে দেখা শেষ করে ঘুরল। এখন সে অবশ্যি আমাকে দেখছে। তার চোখ ভাবলেশহীন। যেন সে আমাকে দেখতে পাচ্ছে না।
আমি বললাম, তুমি কে, ঘরে ঢুকলে কীভাবে?
আমি মেয়েটিকে ভয় পাচ্ছি না। কারণ আমি জানি– স্বপ্ন দেখছি। অতি রূপবতী একটা মেয়েকে স্বপ্নে দেখে কেউ ভয় পায় না। ভূত, প্রেত, সাপ, বাঘ, সিংহ দেখতে ভয় পায়।
মেয়েটা কী কারণে যেন নড়ল। ঝনঝন শব্দ হলো। আমি দেখলাম তার হাতে একগোছা চাবি। সে আবার আয়নার দিকে তাকাল। হাসির মতো ভাব করে টেবিলের উপর রাখা ফিজিক্সের বইটা হাতে নিয়ে কয়েকটা পাতা উল্টাল। সে বইটা রেখে দিল। তবে ঠিক আগে যেখানে ছিল সেখানে রাখল না–একটু সরিয়ে রাখল এবং উল্টো করে রাখল। এখন সে এগিয়ে যাচ্ছে তালাবদ্ধ আলমারির দিকে। আমি তাকিয়ে আছি। ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত সে চাবির গোছা দিয়ে আলমারির তালা খোলার চেষ্টা চালাতেই লাগল।
এক সময় মসজিদে আজান হলো। মেয়েটাকে আর দেখা গেল না। সারারাত জেগেছিলাম। ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়লাম। ভালো ঘুম হলো। আজেবাজে সব স্বপ্ন। বল্লম হাতে কিছু মানুষজন ছুটে আসছে। তাদের সঙ্গে ছোট ছোট বাচ্চা। তাদের হাতে তীর ধনু। আমি প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি। বাচ্চাগুলো বিচ্ছ প্রকৃতির। এদের গতি বাতাসের মতো। আমাকে প্রায় ধরে ফেলে এমন অবস্থা। এরা তীর ছুঁড়ছে। কিছু কিছু গায়ে লাগছে। যেখানে লাগছে সেখানে চিড়বিড় জ্বলুনি। এদের একটা তীর ঘাড়ে লাগল। প্রচণ্ড জ্বলুনিতে ঘুম ভাঙল। জেগে দেখি, বিছানা ভর্তি বড় বড় লাল পিপড়া। এরাই আমাকে কামড়াচ্ছিল। আমার মস্তিষ্ক সেই কামড়ানোকে বাচ্চাদের ছোঁড়া তীর হিসেবে আমাকে দেখিয়েছে।
মানুষের ব্রেইন খুব অদ্ভুত। সে বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা নিজের মতো করে দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠে মনে হলো, আমার ক্ষেত্রেও কি এরকম কিছু ঘটেছে? আমার ব্রেইন একটি তরুণী মেয়ে তৈরি করে আমাকে দেখাচ্ছে।
সারাদিন ঘর থেকে বের হলাম না। সামসুকে দিয়ে পরোটা-ভাজি এনে খেলাম। ইংরেজি উপন্যাসটা পড়ে শেষ করলাম। দুপুরে লম্বা ঘুম দিয়ে জেগে উঠলাম সন্ধ্যাবেলা। সামসুই জেগে উঠাল। চিন্তিত মুখে বলল, সারাদিন ঘুমাইছেন। ঘর থাইকা বাইর হন নাই– শরীর খারাপ?
আমি বললাম, শরীর খারাপ না। রাতে ঘুম হয় নাই এটাই সমস্যা।
সামসু বলল, যে গরম ঘুমাইবেন ক্যামনে? তয় সমস্যা নাই, ইলেকট্রিশিয়ান আনছি। লাইন ঠিক করতেছে। লাইন ঠিক কইরা ফ্যান লাগায়ে দিবে। এক ঘণ্টার মামলা। আমি ইতস্তত করে বললাম, সামসু এই বাড়িতে ভূত-প্রেত আছে নাকি?
সামসু বলল, ঢাকা শহরেই কোনো ভূত নাই। মানুষ থাকার জায়গা নাই ভূত থাকব ক্যামনে? তবে গ্রামগঞ্জে দুই একটা থাকলে থাকতেও পারে।
মিশন প্রেসে একবার যাওয়া দরকার ছিল। সেখানে সারাদিন যা কম্পোজ হয়, সন্ধ্যার পর তার প্রুফ দেখা হয়। মিশন প্রসে যেতে ইচ্ছা করল না। হোটেলে রাতের খাওয়া সারলাম। সস্তার তেহারি এক প্লেট দই। দইটা খেলাম শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্য। শরীর কোনো কারণে গরম হলে মানুষ আজেবাজে স্বপ্ন দেখে।