- বইয়ের নামঃ হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ ছোট গল্প, গল্পের বই
হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য
বই বিষয়ে চৈনিকদের একটি প্রবচন হচ্ছে–বই হল একটা বাগান যা পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। গল্প সংকলনের জনা এই প্রবচন খুব সত্যি। বাগানে নানান ধরনের ফুল, সৌরভ আছে বর্ণ নেই। বর্ণ আছে গন্ধ নেই। গল্প সংকলনেওতো এই ব্যাপারই।
প্রতিটি গল্প শুরুর আগে গল্প বিষয়ে কিছু কথাবার্তা বললাম। গল্পটি কেন লিখেছি, কিভাবে লিখেছি এই সব হাবিজাবি। যে সমস্ত পাঠক হাবিজাবি পছন্দ করেন না তারা মূল গল্পে চলে গেলে ভাল হয়।
সংকলনটির নাম আমার দেয়া না। প্রকাশকের দেয়া। তার ধারণা হিমু নামটা কোন না কোন ভাবে থাকা মানেই বেশি বিক্রি। আমি তরুণ প্রকাশকের ভুল ভাঙ্গাইনি।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশ পল্লী, গাজীপুর।
গন্ধ
‘গন্ধ’ গল্পটি এক বৈঠকে লেখা। আমার পছন্দের গল্প। আমার ধারণা এই সংকলনের সবচে ভাল গল্প। পাঠক বিবেচনা করুন।
*
আব্দুল করিম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল রাত শেষ হলেই তার ফাঁসি হবে। ফাঁসিগুলো সাধারণত ফজরের আজানের আগে আগে হয়। ফাঁসি হয়ে যাবার পর জল্লাদ অজু করে ফজরের নামায পড়ে। সেই হিসেবে আব্দুল করিমের হাতে দশ ঘণ্টা সময় আছে।
জেলার নিজে এসেছেন। সেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে সিগারেট। তিনি নার্ভাস ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিচ্ছেন। তিনি সরাসরি করিমের চোখের দিকে তাকাচ্ছেনও না।
করিম।
জি স্যার?
সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে? সিগারেট খাবেন?
করিম বলল, জি স্যার খাব।
জেলার সিগারেটের প্যাকেট গরাদের ভেতর দিয়ে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, প্যাকেটটা রেখে দিন।
করিম বলল, শুকরিয়া।
রাতে কী খেতে ইচ্ছা করছে বলুন তো?
করিম বলল, স্যার আজই কি ফাঁসি হবে?
জেলার সাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, সেটাতো বলতে পারছি না।
করিম বলল, কী খেতে চাই জানতে চাচ্ছেন এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি।
জেলার নিজেকে সামলাতে সামলাতে বললেন, আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে যাদের ফাঁসির হুকুম হয়েছে তাদের কিছু খাওয়াতে ইচ্ছা করে– এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি।
আলু ভাজি খেতে ইচ্ছে করছে।
শুধু আলুভাজি?
জি স্যার! আলুভাজির সঙ্গে শুকনা মরিচ ভাজি আর দুই চামচ গাওয়া ঘি।
মাছ মাংস কিছু না?
যদি সম্ভব হয় ডিমওয়ালা শিং মাছের ঝোল।
অবশ্যই সম্ভব হবে। কেন সম্ভব হবে না? কাউকে কিছু কি জানাতে হবে? আমাকে বলতে পারেন। আমি অবশ্যই জানাব।
কাউকে কিছু জানাতে হবে না স্যার। আপনার অনেক মেহেরবানি।
রাত ন’টার মধ্যে খাবার চলে আসবে।
শুকরিয়া।
জেলার সাহেব চলে গেছেন। সিগারেটের প্যাকেট হাতে আব্দুল করিম মেঝেতে পাতা কম্বলের বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে আছে। সিগারেট সে এখনো ধরায় নি। তার সঙ্গে দেয়াশলাই নেই। ফাঁসির সেলের কয়েদিদের দেয়াশলাই লাইটার রাখতে দেয় না। তবে সিগারেট ধরানো কোনো বিষয় না। গার্ডকে বললেই ধরিয়ে দেবে।
প্যাকেটে সিগারেট আছে আঠারোটা। দশ ঘণ্টার জন্য আঠারোটা সিগারেট। ঘণ্টায় দু’টা করে সিগারেট খাওয়া যাবে। করিম বিছানা থেকে উঠে গরাদ ধরে দাঁড়ালো। গার্ড সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত। ফাঁসির আসামিকে শেষ সময়ে গার্ডরা যথেষ্ট মায়া-মমতা দেখায়।
করিম বলল, একটা সিগারেট ধরাব।
গার্ডের কাছে লাইটার ছিল না, সে দৌড়ে কোত্থেকে লাইটার নিয়ে এল। করিম বলল, বাংলা মাস কী জানেন?
অগ্রহায়ণ মাস।
করিম সিগারেটে টান দিল। গ্রামের দিকে অগ্রহায়ণ মাসে তীব্র শীত পড়ে। কথায় মানে না এমন শীত। অথচ ঢাকা শহরে শীত নেই। জেলখানায় শীত আরো কম। দেড় বছরের উপরে সে জেল হাজতে আছে। শীতকাল বলে যে একটা ঋতু আছে বুঝতেই পারে নি। জেলাখানায় একটাই ঋত–গরম কাল।
গার্ড বলল, পান খাবেন? একটা পান এনে দেই?
করিম বলল, এখন পান খাব না। ভাত খাওয়ার পরে একটা খাব।
গার্ড বলল, কোনো চিন্তা নাই। জর্দা দিয়ে ডাবল পান এনে দিব।
করিম বলল, শুকরিয়া।
শুকরিয়া বলা সে শিখেছে যমুনার কাছ থেকে। মুন্সি মাওলানারা কথায় কথায় শুকরিয়া বলে। তার স্ত্রী যমুনা কোনো মুন্সি মাওলানা বা মাওলানা ঘরের মেয়েও না। কার কাছ থেকে সে শুকরিয়া বলা শিখেছিল কে জানে! একদিন করিম জিজ্ঞাসা করেছিল। যমুনা অন্যদিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল– বলব না।
বলব না বলাও তার আরেক রোগ। কিছু জানতে চাইলেই বলতো বলব না।
একদিন দুপুরে বাসায় খেতে বসে দেখে এলাহি আয়োজন। পোলাও, কোর্মা, খাসির রেজালা। অথচ ছুটির দিন বলে সে সকালে নিজেই বাজার করেছে টেংরা মাছ, কচুর লতি এবং ছোট চিংড়ি। করিম বিস্মিত হয়ে বলল, ব্যাপার কী?
যমুনা যথারীতি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসতে হাসতে বলল, বলব না। ঘটনা কী রাতে জানা গেল। তাদের বিয়ের দিন। করিম বিয়ের প্রথম বছরেই এই দিনটা ভুলে গেল। আফসোস।
তাদের বিয়ে হয়েছিল পৌষ মাসে। নেত্রকোনার পৌষ মাসের শীত যে কী জিনিস যারা সেই সময় নেত্রকোনায় যাবে না তারা কোনোদিনই জানবে না। মেয়ের বাড়িতেই বাসর হলো। ফুল দিয়ে সাজানো পুরনো আমলের খাট। আয়োজনের কোনো কমতি নেই। সমস্যা একটাই, গায়ে দেবার জন্যে পাতলা ফুল তোলা একটা কথা ছাড়া কিছু নেই। যে দেশে ডাবল লেপে শীত মানে না সেই দেশে নতুন জামাইকে দেয়া হয়েছে পাতলা একটা কথা।