এইটা কি আপনার গল্প।
জি।
আপনার গল্প শুনে খুশি হয়েছি। আপনি যে আমার একটি বই পড়েছেন সেটা জেনেও ভালো লাগল।
আমার কথা একটু বাকি আছে।
জি বলুন।
ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, আমি নিজে একটি গল্পগ্রন্থ রচনা করেছি। সেই গ্রন্থটি নিয়ে এসেছি।
এতক্ষণ ভদ্রলোকের আগমনের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হলো। তিনি একজন গ্রন্থকার। গ্রন্থ প্রকাশে আমার সাহায্যের জন্যে এসেছেন। আমার মন খারাপ হলো এই ভেবে যে আমি ভদ্রলোককে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারব না। তার লেখা যত ভালোই হোক প্রকাশকরা ছাপবেন না। পরিচিতিহীন মফস্বলের লেখকদের প্রতি ঢাকার প্রকাশকদের কোনোই আগ্রহ নেই। আমি বললাম, আপনি কি বইটি প্রকাশের ব্যাপারে আমার সাহায্য চান?
জি-না। বইটি প্রকাশিত হয়েছে।
ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বইটি আমার হাতে দিলেন। আমি বইয়ের পাতা উল্টে চমকে উঠলাম। দুটি কারণে চমকালাম প্রথম কারণ, বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে আমার নামে। উৎসর্গপত্রে এমন কথা লেখা হয়েছে–আমি যার যোগ্য নই। দ্বিতীয় কারণ হলো, এই নিরহংকারী চুপচাপ ধরনের মানুষটি একজন বিখ্যাত মানুষ। এতক্ষণ আমি তাকে চিনতে পারি নি। ইনি দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা। গবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক। বাংলা একাডেমী তার একটি জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। লিপির উপর লেখা তাঁর গ্রন্থ ব্রাহমী অথবা ব্রাহ্মী লিপি ও সম্রাট প্রিয়দর্শী পশ্চিম বাংলার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য।
লিপিতত্ত্বে এদেশে এবং ভারতে তার চেয়ে বেশি কেউ এ সময়ে জানেন বলে আমার জানা নেই।
আমি একই সঙ্গে মুগ্ধ, বিস্মিত এবং লজ্জিত হলাম। এই সরল সাদাসিধা মানুষটিকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি–এ কী কাণ্ড! এতবড় ভুল মানুষ করে? গোলাম মোর্তাজা সাহেব উঠে দাঁড়ালেন এবং হাসিমুখে বলেন, আপনি কি একবার আমাদের হবিগঞ্জে যাবেন? আমার বাড়িতে একরাত থাকবেন?
আমি বললাম, অবশ্যই থাকব।
কথা দিচ্ছেন?
হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি।
আমার মেয়েরা খুব খুশি হবে। এরা যে আপনাকে কত পছন্দ করে আপনি তা কখনো জানবেন না। আমি আমার মেয়েদের জন্যে কিছু করতে পারি নি। আপনাকে নিয়ে গেলে ওদের জন্যে কিছু করা হবে।
আপনি যখন আমাকে যেতে বলবেন, আমি তখনি যাব।
আমি আপনাকে জানাব।
তিনি আমাকে কিছু জানাতে পারলেন না। হবিগঞ্জ ফিরেই অসুখে পড়লেন–প্রাণঘাতী ব্যাধি-ক্যানসার। চিকিৎসার জন্যে গেলেন জার্মানি। পত্রিকা মারফত তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেলাম। মনটা খারাপ হলো। কথা দিয়েছিলাম, কথা রাখা গেল না।
তার প্রায় বছরখানিক পরের কথা–দেওয়ান গোলাম মোতার্জার পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হলো–দেওয়ান গোলাম মোর্তাজার নামে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ট্রাস্টি বোর্ডের পক্ষ থেকে মোর্তাজা সাহেবের স্ত্রী আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন মোর্তাজা সাহেবের মৃত্যুদিবস উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। কথা রাখার সুযোগ পাওয়া গেল। আমি তিন কন্যা নিয়ে হবিগঞ্জে উপস্থিত হলাম।
হবিগঞ্জে পৌঁছে মোর্তাজা সাহেবের পরিবারের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেলাম তার সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় নেই। এরা আমার মতো অভাজনের জন্যে ভালোবাসার সোনার আসন বানিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমি একেবারেই হকচকিয়ে গেলাম।
মোর্তাজা সাহেব সেখানে কবি সাহেব নামে পরিচিত। তাঁর বাড়ি হলো-কবি সাহেবের বাড়ি। তার মেয়েদের পরিচয় হলো–কবি সাহেবের মেয়ে।
কবি-পত্নীর নাম আম্বিয়া খাতুন। অসম্ভব রূপবতী, কঠিন ধরনের মহিলা। থাকেন কানাডায়। স্বামীর মৃত্যুদিবস অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেশে এসেছেন। স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। লেখক-স্বামীকে পারিবারিক সব দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত রাখতে গিয়ে নিজের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে এখন ক্লান্ত এবং স্বামীর প্রতি কিছুটা হয়তো অভিমানী।
কবি-পত্নী তার সব কন্যাকে স্কুলের ছাত্রদের মতো লাইন করে দাঁড় করালেন। আমাকে দেখিয়ে কঠিন গলায় বললেন, ইনি তোমাদের বাবার বন্ধু। ইনি তোমাদের চাচা। চাচাকে পা ছুঁয়ে সালাম করো।
বড় বড় মেয়ে, সবাই বিবাহিতা। তাদের ছেলেমেয়েরাও বড় বড়। মার কথা শোনামাত্র আমাকে হতচকিত করে এরা একসঙ্গে আমাকে সালাম করবার জন্যে ছুটে এল। একজনকে দেখলাম কাঁদছে।
আমি বললাম, আপনি কাঁদছেন কেন?
সে জবাব দিল না। তাঁর এক বোন বলল, ও তো আপনার কথা শুনতে পাচ্ছে না। ও কানে শুনতে পায় না। বাচ্চা হওয়ার কী এক জটিলতায় ওর কান নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে কোনো প্রশ্ন করলে কাগজে লিখে করতে হবে।
আমার মনটাই খারাপ হলো। আমি এক টুকরা কাগজ নিয়ে লিখলাম–আপনি এত কাঁদছেন কেন?
মেয়েটি তার উত্তরে বলল, চাচা, আপনি অবিকল আমার বাবার মতো। নিরহংকারী সাদাসিধা। আপনাকে দেখে বাবার কথা মনে পড়ছে–এইজন্যে আমি কাঁদছি।
আমি সারাজীবন শুনে এসেছি, আমি অহংকারী। এই প্রথম একটি মেয়ে আমাকে বলল, নিরহংকারী। আমার চোখ প্রায় ভিজে উঠার উপক্রম হলো।
কবি-কন্যা বলল, চাচা, আসুন, আমার বাবার লাইব্রেরিটা আপনাকে দেখাই। আমরা বাবার লাইব্রেরিতে যাই না। আজ আপনার সঙ্গে যাব। আর শুনুন, আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।
আচ্ছা তুমি করেই বলব, তোমরা বাবার লাইব্রেরিতে যাও না কেন?
মা এক কাণ্ড করে রেখেছেন, এইজন্যে যেতে ইচ্ছা করে না।