এ জাতীয় নির্যাতন শুধু যে পশুদের উপর হয় তা না মানুষের উপরও হয়। খুব শৈশবে দেখা ছবি। গ্রামের একটি তরুণী বধূকে ভূতে ধরেছে। ভূতে ধরলে লজ্জা শরম নাকি থাকে না–মেয়েটি গায়ের কাপড় বারবার ফেলে দিচ্ছে। গ্রামে পর্দা প্রথা কঠিন। কিন্তু ভূত ধরা মেয়েদের জন্যে মনে হয় পর্দা প্রথার কড়াকড়ি তেমন নেই। অনেক পুরুষ মানুষ উঁকি দিয়ে দেখছে। যে ওঝা মন্ত্র পাঠ করছে-সে-ও মাঝ বয়সী। মন্ত্র পাঠ করার ফলে মেয়েটির সারা গায়ে হাত বুলাবার সুযোগ পাচ্ছে। এই কাজটিতে সে আনন্দ পাচ্ছে বলেই মনে হয়। একপর্যায়ে সে মেয়েটির গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলল। বড়া আমাদের তাড়া দিল, পুলাপান কী দেখে? দূর হও, দূর। হও। আমরা দূর হলাম। বড়দের জগতের সব কাণ্ডকারখানা আমরা বুঝি না। দূর হওয়াই ভালো। তা ছাড়া ওঝা এখন শুকনা মরিচ পোড়াতে দিয়েছে মেয়েটির দুই নাকের ফুটায় জ্বলন্ত শুকনো মরিচ ঠেসে ধরা হবে। এই দৃশ্য না দেখাই ভালো।
আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় একবার এক বৃদ্ধ মহিলা তার কলেজে পড়া নাতিকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন। নাতিকে খুব লায়েক মনে হলো। তার গায়ে রঙচঙা শার্ট, দিনের বেলাতেও চোখে কালো চশমা। তাঁদের সঙ্গে পেটমোটা কালো ব্যাগ। ভদ্রমহিলা ব্যাগ খুলে নানা কাগজপত্র বের করতে লাগলেন। কাগজপত্রের। সঙ্গে আছে পত্রিকার ক্লিপিং, প্রশংসাপত্র। আমি বললাম, ব্যাপার কী? তিনি বললেন, আগে এইগুলান মন দিয়া পাঠ করেন। পরে কথা বলব। কথার দাম নাই–লেখার দাম আছে।
আমি যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে কাগজপত্র পড়ে যা জানলাম তা হচ্ছে–তিনি ক্যানসার, এপিলেপ্সি এবং জলাতংক রোগ সারাতে পারেন এবং গ্যারান্টি সহকারে সারান। এই তিন কালান্তর ব্যাধি যিনি সারাতে পারেন তার অবস্থা দেখে মায়া লাগে। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। শাড়িতে কোনো তালি চোখে পড়ল না, তবে গায়ের চাদরে তালি।
বুঝলেন ভাইডি, আমি তিন ধরনের চিকিৎসক। আফনেরে ভাই ডাকলাম। আফনে আমার মর্ম বুঝবেন।
আমি বোনের মর্ম তেমন বুঝলাম না। ভদ্রমহিলাকে দেওয়া প্রশংসাপত্র দেখতে লাগলাম। একটি প্রশংসাপত্র জনৈক সিভিল সার্জনের দেওয়া। তিনি লিখেছেন (ইংরেজি ভাষায়) এই মহিলা ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে আক্রান্ত একজনকে সারিয়ে তুলেছেন। তিনি তার চাক্ষুষ সাক্ষী। তিনি এই মহিলার সাফল্য কামনা করেন।
যে মানুষ ম্যালিগন্যান্ট টিউমার সারিয়ে তোলে তাকে নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে হৈচৈ পড়ে যাওয়ার কথা। সিভিল সার্জন ভদ্রলোক কোনো হইচই-এ না গিয়ে একটি প্রশংসাপত্র দিয়েছেন।
আমি বললাম, আপনি কী করে রোগ সারান? ওষুধপত্র দেন?
ওষুধপত্র আমার কিছু নাই ভাইডি। আমার আছে মন্ত্র।
মন্ত্র পেয়েছেন কীভাবে?
গায়েবিতে পাইছি। আছরের নামাজ পইড়ে জায়নামাজে বইস্যে তসবি টানতেছি তখন গায়েবিতে পাইলাম।
তিন রোগের জন্যে এক মন্ত্র? না তিন রোগের তিন মন্ত্র?
একই মন্ত্র। তয় ভাইডি পড়নের কায়দা ভেন্ন।
আমার কাছে কী জন্যে এসেছেন?
এইটা কী কথা কলেন ভাইডি? বোন ভাইয়ের কাছে আসবি না?
তা তো আসবেই। তবু আপনার কোনো উদ্দেশ্য থাকলে বলুন।
একটা চিডি যে দেওয়া লাগে ভাইডি। একটা কাগজে লিখে দেবেন–আমার। চিকিৎসায় রোগ সারে। তারপরে নাম সই করবেন।
আমি বিরস গলায় বললাম, ক্যানসার, এপিলেপ্সি এবং জলাতংক এই তিন রোগের যে কোনো একটা যদি আমার হয়, আপনারে খবর দেব। তারপর আপনি এসে মন্ত্রপাঠ করে আমার অসুখ সারাবেন। তখন আমি প্যাডে সুন্দর করে সার্টিফিকেট দেব।
আমার বোন কথা শুনে রেগে গেলেন। খিটমিটে গলায় বললেন, এতগুলান লোক যে চিডি দেল? এরা কী মিথ্যা দেল? এর মধ্যে একজনায় আছে মন্ত্রী। ওরে, সেকান্দর মন্ত্রীর চিড়ি উনারে দেখা।
সেকান্দর মন্ত্রীর চিঠি বের করে দিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্যাডে প্রশংসাপত্র।
কী, ভাইডি দেখলেন?
জি দেখলাম।
বিশ্বেস হলো?
হয় নি।
না হইলে কী আর করা? জোর কইরে তো বিশ্বাস করানো যায় না! তা ভাইডি, জোহর হয়েছে–জায়নামাজ দিতে বলেন, নামাজ পড়া লাগবে।
আপনি নিয়মিত নামাজ পড়েন?
এইটা কী কথা বলেন ভাইডি? সাত বছর বয়স থেইকে নামাজ পড়ি। একবার অসুখে কাজা গেল। কাফফারা দিলাম।
আমি বললাম, ইসলাম ধর্মে মন্ত্র-তন্ত্র নিষিদ্ধ, তা কি জানেন না? আমাদের ধর্মে বলা হয়েছে যারা মন্ত্র-তন্ত্র করে এবং যারা এইসব বিশ্বাস করে তারা কবিরা গুহাহ করে।
সবই জানি ভাইডি। তয় এর মধ্যে বিষয় আছে। তুমি বুঝবা না, তোমার জ্ঞান কম।
আমার বোনকে বিদেয় করতে যথেষ্ট কষ্ট করতে হলো। বোনের হাঁটুতে বাতের ব্যথা, চিকিৎসা করাবেন। সেই চিকিৎসার খরচ বাবদ একশ টাকা এবং রিকশা ভাড়া বাবদ দশ টাকা দিতে হলো।
তিনটি কালান্তক ব্যাধির চিকিৎসায় যিনি সিদ্ধহস্ত তাঁকে সামান্য হাঁটুর ব্যথায় কাতর হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখলাম।
.
সম্প্রতি আমার বাসায় উইপোকার আগমন ঘটেছে। উইপোকা বই কেটে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। নানান ওষুধপত্র দিয়েও তাদের কাবু করা যাচ্ছে না। এরা শুধু যে বই খাচ্ছে তাই না, বইয়ের আলমিরাও খেয়ে ফেলছে। মন খুব খারাপ, এই অবস্থায় আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক বললেন, উইপোকা এম্নিতে দূর হবে না। এরা ভয়াবহ। সব ছারখার করে দেবে। তবে তিনি উইপোকা দূর করার মন্ত্র জানেন। আমি যদি চাই তিনি মন্ত্র পাঠ করে উইপোকা দূর করবেন। আমি বললাম, মন্ত্রে উইপোকা দূর হবে?