মা : সে উন্মাদ।
ভদ্রমহিলা : আহারে, কী সর্বনাশ! সবচেয়ে ছোটটা উন্মাদ?
মা : সে উন্মাদ না। জল উন্মাদ নামে একটা পত্রিকা বের করে।
ভদ্রমহিলা হতভম্ব। তাঁর সঙ্গে রসিকতা করায় খানিকটা রাগ। মা নির্বিকার।
আমি তখন ‘অচিন রাগিনী’ নামের তিন খণ্ডের একটা নাটক বানিয়েছি। মা আমার বাসায় বেড়াতে এসেছেন। নাটক আমার সঙ্গে দেখবেন। তিনি আগ্রহ নিয়ে নাটক দেখলেন। আমি বললাম, কেমন লাগল?
মা বললেন, তোর নাটক দেখতে দেখতে একটা কথা মনে হলো। তোর বাবা আগেভাগে মারা গিয়ে তোর জন্যে সুবিধা করে দিয়েছে।
আমি বললাম, কী রকম?
মা বললেন, সে ছিল নাটকপাগল। তোর নাটকে আসাদুজ্জামান নূর যে পার্টটা করেছে, এটা সে করার জন্যে তোকে বলত। তুই পার্ট তাকে দিতি না। এই নিয়ে পিতাপুত্রের মন কষাকষি। সমস্যা না? আগেভাগে মারা যাওয়ায় তুই বিরাট বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছিস।
এইবার মাকে নিয়ে আমার রসিকতার গল্প। বাবার পোস্টিং তখন কুমিল্লায়। পুলিশের ডিএসপি। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। ছুটিতে কুমিল্লায় গিয়ে দেখি মা মুরগি পুষছেন। তিনটা মুরগি। মুরগি ডিম পাড়বে। ওই ডিম খাওয়া হবে। প্রতিদিন সকালে মা খাঁচা খুলে আগ্রহ নিয়ে দেখেন মুরগি ডিম পাড়ল কি না। প্রতিদিন তাঁকে হতাশ হতে হয়। আমি গোপনে ডিম কিনে এনে রাতে চায় রেখে দিলাম। সকালে ঘুম ভাঙল মা’র আনন্দ-চিৎকারে। তিনটা মুরগি একসঙ্গে ডিম দিয়েছে। এরপর থেকে প্রতিদিনই খাঁচায় তিনটা করে ডিম পাওয়া যেতে লাগল। সবাই খুশি। একদিন মা’র আনন্দধ্বনি শোনা গেল না। অথচ আমি রাতে তিনটা ডিমই রেখেছি। তিনি ডিম হাতে আমার কাছে এসে বললেন, এইসব কী! মা’র সঙ্গে ফাজলামি?
আমি বললাম, কী করেছি?
মা বললেন, এই তিনটা তো হাঁসের ডিম। মুরগি তো হাঁসের ডিম পাড়বে না।
আমি বললাম, মা, ভুল হয়েছে। এরকম আর করব না।
মা এই ঘটনায় খুবই আহত হলেন। বাবার কাছে নালিশ করলেন। বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাকে যমের মতো ভয় পাই। ভয়ে অস্থির হয়ে তাঁর কাছে গেলাম। বাবা বললেন, মুরগির ডিমের বদলে তুই হাঁসের ডিম কিনলি কী মনে করে?
আমি বললাম, মুরগির ডিমই চেয়েছি। ডিমওয়ালা হাঁসের ডিম দিয়েছে।
বাবা বললেন, সবচেয়ে ভালো হতো পচা ডিম রাখলে। তোর মা ডিম ভাঙত, বিকট গন্ধে বাড়ি ভরে যেত। তিনটা একসঙ্গে পচা ডিম কেন পাড়ল–এই নিয়ে আমরা তখন গবেষণায় বসতাম।
পাঠক, আমার বাবার রসবোধ কি ধরতে পারছেন?
মানুষ যেমন রসিকতা করে প্রকৃতিও কিন্তু করে। সেই রকম একটা গল্প বলি। মা’র প্রতি প্রকৃতির রসিকতা।
মা তখন খুবই অসুস্থ। কিডনি প্রায় অকেজো। বিছানায় বসে থেকেই ঘুমিয়ে পড়েন। ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না। একদিন হঠাৎ অচেতন হয়ে গেলেন। অ্যাম্বুলেন্স এনে তাকে ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তাকে CCU-তে রাখা হলো। ডাক্তার বরেন চক্রবর্তীর রোগী। তার জ্ঞান ফিরল রাত তিনটায়। তিনি দেখলেন, সবুজ পর্দা ঘেরা একটা ঘরে তিনি শুয়ে আছেন। আরামদায়ক আবহাওয়া। তার সামনে সবুজ পোশাক পরা দু’টি রূপবতী (এবং বেঁটে) তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। [এরা নার্স। মার খোঁজ নিতে এসেছিল।]
মা’র ধারণা হলো তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তার বেহেশত নসিব হয়েছে। কারণ বেহেশত সবুজ, এই খবর তিনি জানেন। মেয়ে দুটি যে হুর এটাও বুঝা যাচ্ছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে তিনি হুরদের জিজ্ঞেস করলেন, মা, এটা কি বেহেশত?
হুর দু’জন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে রোগীকে সন্তুষ্ট করার জন্যে বলল, জি খালাম্মা।
মা বললেন, তোমরা আমাকে বেহেশতের আঙ্গুর এনে দাও তো। খেয়ে দেখি কী অবস্থা।
হুর দু’জন আঙ্গুর নিয়ে এলে কী হতো আমি জানি না। তার আগেই ডিউটি ডাক্তার ঢুকলেন এবং বললেন, খালাম্মার জ্ঞান ফিরেছে। আপনার ছেলেমেয়েরা সবাই বাইরে আছে। ডেকে দেই কথা বলেন।
এই ঘটনার পর একদিন মাকে বললাম, আপনার কি খুব বেহেশতে যাওয়ার ইচ্ছা?
মা বললেন, হ্যাঁ।
আমি বললাম, আপনি তো লোভী মহিলা না। বেহেশতের লোভ কেন করছেন?
মা বললেন, বেহেশতে না গেলে তোর বাবার সঙ্গে তো দেখা হবে না। তোর বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই বেহেশতে যেতে চাই।
আমি বললাম, প্রথম দেখাতে তাকে কী বলবেন?
বলব, ছয়টা ছেলেমেয়ে আমার ঘাড়ে ফেলে তুমি চলে গিয়েছিলে। আমি দায়িত্ব পালন করেছি। এদের পড়াশোনা করিয়েছি। বিয়ে দিয়েছি। এখন তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করবে। বেহেশতের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলি আমাকে দেখাবে। শুধু আমরা দু’জন ঘুরব। তুমি তোমার সঙ্গের হুরগুলিকে বিদায় করো।
মৃত্যু একটি ভয়াবহ ব্যাপার। যখন মাকে দেখি সেই ভয়াবহ ব্যাপারটির জন্যে তিনি আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করছেন, অবাক লাগে।
মাইন্ড গেম
তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা (Theoretical physics) ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার চেয়ে মনে মনে অর্থাৎ কল্পনায় পরীক্ষা করতে পছন্দ করেন। এই পরীক্ষাগুলোকে বলে Thought experiment। শ্রোডিনজারের বিড়াল হলো চিন্তাপরীক্ষার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।
আমরা আমজনতারা চিন্তা পরীক্ষা করতে পারি না। তবে Mind game বা চিন্তা খেলা খেলতে পারি। এই খেলা আমার বিশেষ পছন্দের। খেলার নমুনা দিচ্ছি। একটি আট বছরের বালকের সঙ্গে এই খেলা খেলছি। বালকটির নাম ধরা যাক শুভ্র। মার এবং তার মধ্যে কথোপকথন