পানিভাত। নববর্ষে পান্তাভাত ইলিশ মাছ ভাজা দিয়া খাইতে হয়। আমাদের নিয়ম।
নিয়ম?
জি স্যার, আমরা কঠিন নিয়মের মানুষ। নিয়মের বাইরে যাই না।
তোমাদের আর কী নিয়ম?
পোশাকে নিয়ম আছে। ফাল্গুন মাসের এক তারিখে মেয়েদের পরতে হয় হলুদ শাড়ি। আজ পরতে হয় লাল শাড়ি।
শাড়ি বিষয়ে বলি। শাড়ি বাংলাদেশের মেয়েদের প্রধান পোশাক। এটা ছয় গজ লম্বা ও সোয়া গজ প্রস্থের একখণ্ড বর্ণিল বস্তু। মেয়েরা প্রথমে স্কার্ট ও টপস পরে, তারপর শাড়ি দিয়ে স্কার্ট টপস ঢেকে দেয়। টপসকে এরা বলে ব্লাউজ এবং স্কার্টকে বলে শায়া। কোনো বোতাম বা ফিতা ছাড়াই অদ্ভুত এক উপায়ে এ দেশের মেয়েরা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রাখে। আমাকে বলা হয়েছে, শাড়ি গা থেকে খুলে পড়ার ঘটনা কখনোই ঘটে না।
হামিদ ঝড়ের গতিতে রিকশা চালাচ্ছে। আমি বললাম, এত তাড়া কিসের! আস্তে চালাও। এক্সিডেন্ট করবে।
হামিদ বলল, তাড়াতাড়ি না গেলে আরেকটা জিনিস মিসিং হবে।
কী জিনিস?
আর্ট কলেজের পুলাপান এই দিনে পাগলা মিছিল বাইর করে। তারা পাগলা। তো, এই কারণে তারার মিছিলও পাগলা। না দেখলে জেবন বৃথা।
পাগলা মিছিল দেখলাম। মুখোশ মিছিল। উদ্দাম আনন্দের শোভাযাত্রা। ব্রাজিলের সাম্বা উৎসবের শোভাযাত্রার সঙ্গেই কেবল এই মিছিল তুলনীয়।
হামিদ মিয়া এক চটপটির দোকানের পাশে তার রিকশা জমা রেখে আমাকে নিয়ে রমনা উদ্যানে ঢুকল। উদ্যানে বৃক্ষের অরণ্যের ভেতর সুখী মানুষের অরণ্য। কত না তাদের আনন্দ! বাবার কাঁধে শিশু ভেঁপু বাজাচ্ছে। মা কাঁচের চুড়ি কিনছে। (এই উৎসবে মেয়েদের কাঁচের চুড়ি কেনা নাকি বাধ্যতামূলক।)
রিকশাওয়ালা তার পরিবারকে খুঁজে বের করল। হতদরিদ্র এই পরিবারটিরও আনন্দের সীমা নেই। হামিদের দুই মেয়ে মাটির খেলনা কিনেছে। শিশুদের মাটির খেলনা কিনে দেওয়াও নববর্ষ অনুষ্ঠানের অঙ্গ।
হামিদ আমাকে পান্তা খেতে নিয়ে গেল। সে বলল, স্যারের পান্তার টেকা আমি দিমু। স্যার আইজ আমার মেহমান।
হামিদের পরিবারের সঙ্গে আমি মাটির হাঁড়িতে পান্তা খেতে বসলাম। হামিদ ব্যস্ত হয়ে পড়ল ইলিশ মাছের একটা বড় টুকরা যেন আমি পাই।
আমি আমেরিকান। আমেরিকানরা আবেগশূন্য না। তবে আবেগে আমেরিকানদের চোখ কখনো ভিজে ওঠে না। আমি লক্ষ করছি, আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠছে। যে দেশের মানুষ দুঃখ-কষ্ট-হতাশা-বঞ্চনা একপাশে ফেলে। আনন্দে মেতে উঠতে পারে, সে দেশের মানুষ অনেকদূর যাবে তা বলাই বাহুল্য। থ্রি চিয়ারস ফর দেম! হিপ হিপ হুররে!!
পাদটীকা (কিছু তথ্য)
বঙ্গদেশে নববর্ষ উৎসব ছিল না। ছিল চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। মাইকেল মধুসূদনের বন্ধু হেডমাস্টার রাজনারায়ণ বসু তার স্কুলে নববর্ষ পালনের ব্যবস্থা করেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করেন শান্তিনিকেতনে।
বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) নববর্ষ পালনের সূচনা হয় কবি জাহানারা আরজুর বাসায়, ১৯৬৪ সালে। সেখানে তরুণ কবি হাসান হাফিজুর রহমান বৈশাখ নিয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর নববর্ষ উদ্যাপন বন্ধু হয়ে যায়।
রমনা বটমূলে প্রভাতের সূর্যোদয়ের সঙ্গে নববর্ষ। উদ্যাপনের শুরু করে ছায়ানট।
আরেকটি তথ্য, একমাত্র নেপাল ছাড়ুবাংলা ক্যালেন্ডার সরকারিভাবে পৃথিবীর কোথাও ব্যবহার হয় না। অতি অদ্ভুত এক মিল আমরা খুঁজে পাই পাঞ্জাবিদের বৈশাখী উৎসবের সঙ্গে। তারাও পয়লা বৈশাখ পালন করে নতুন বর্ষের প্রথম দিবস হিসেবে। বিস্তারিত আমার জানা নেই।
একটি ভৌতিক গল্পের পোস্টমর্টেম
সম্প্রতি আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে একটি ভৌতিক গল্পকে কাটাছেঁড়া করার। আমি যে খুব আগ্রহের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়েছি তা-না। গল্প থাকবে গল্পের মতো। তাকে কাঁটাছেঁড়া করা হবে কেন? একজন মানুষের জীবনে নানান ধরনের অভিজ্ঞতা ঘটে। অভিজ্ঞতাগুলো তার ব্যক্তিগত গল্প। এইসব গল্পের কিছু থাকে অতিপ্রকৃত বা ভৌতিক। এই গল্পগুলো সে গভীর মমতায় লালন করে। বৃদ্ধবয়সে নাতি-নাতনিদের নিয়ে অভিজ্ঞতার গল্প বলতে বলতে নিজে রোমাঞ্চিত হন। নাতি-নাতনিরা অবাক হয়ে বলে, সত্যি এমন ঘটেছিল। সাধারণত এ ধরনের গল্পে পালক যুক্ত হতে হতে মূল গল্প হারিয়ে যায়।
গল্পে আছে এক মহিলার এক ছেলের জন্ম দিয়েছে, গায়ের রঙ কালো। ধাত্রী তার বাড়ি ফিরে গল্প করল, অমুক মহিলার এক ছেলে হয়েছে। গায়ের রঙ কাকের মতো কালো। লোকমুখে গল্প ছড়াতে লাগল। শেষ অংশ হচ্ছে–এক মহিলা একটা কাকের জন্ম দিয়েছে। কাকটা কা কা করছে তবে ফাঁকে ফাঁকে ‘মা’ ডাকছে। কা কা মা। মা কা কা…
জটিল ভৌতিক অভিজ্ঞতা প্রায় সময়ই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয় না। যিনি গল্পটি বলছেন তার আত্মীয়ের অভিজ্ঞতা। সেই আত্মীয় আবার জীবনে কখনো মিথ্যা বলেন টাইপ।
যখন আমার বয়স কম ছিল, তখন বেশ কয়েকবার গল্পের পেছনে দৌড়িয়েছি। বরিশাল বিএম কলেজে কেমিস্ট্রির M.Sc. পরীক্ষার এক্সটারনাল হিসেবে একবার গিয়েছি। সেখানে শুনলাম মাইল তিনেক দূরে একটা ভাঙা রহস্যময় কুয়া আছে। কুয়ার পানির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে পানি হঠাৎ খলবল করে উঠে এবং প্রশ্নের উত্তর দেয়।
পরীক্ষার ভাইবা শেষ করে নৌকা নিয়ে আমি অদ্ভুত কুয়া দেখতে গেলাম। বরিশালের সরু খালবিলে নৌকা নিয়ে যাওয়া এক ধরনের দিগদারি। জোয়ার ভাটা দেখে নৌকা ছাড়তে হয়। তিন মাইল যেতেই আমার সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। ফলাফল শূন্য। কুয়াতে মুখ রেখে অনেকক্ষণ “হ্যালো হ্যালো, তুমি কে? কথা বলো।” এইসব করলাম। কুয়া বা কুয়ার পানি কোনো জবাব দিল না। খলবলানিও নেই। যিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি বললেন, আজকের ঘটনাটা বুঝলাম না। মনে হয় আপনেরে ভয় খাইছে। কুয়া কেন আমাকে ভয় খাইছে কে বলবে?