সংলাপটি দেওয়ার উদ্দেশ্য সমাজে এই সময়ের নারীর অবস্থান বোঝানো। আজ এই কথা কেউ বলবে না, কিন্তু তখন বলত। ময়মনসিংহের একটি প্রবচন হচ্ছে, ‘জরু ও গরুকে মারের উপর রাখতে হয়’। তারও আগে যদি যাই তাহলে দেখি রামায়ণেও এই উক্তি আছে। তুলসী দাসের রামচরিত মানসে লেখা—
‘ঢোল, গবার, শুদ্র, পশু, নারী–এদের মারের উপর রাখতে হয়।’
আমি এ-জাতীয় সংলাপ ব্যবহার করছি বলেই এটা আমার মনের কথা তা মনে করার কোনো কারণ নেই।‘ বহুব্রীহি’তে এমদাদ খোন্দকার বলতেন, “মেয়েছেলের পড়াশোনার কোনোই দরকার নাই–তারা থাকবে রান্নাঘরে”। এটা এমদাদ খোন্দকারের কথা। আমার না। অথচ শিক্ষিত লোকজন ভেবে বসলেন, প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষ নিয়ে আমি ‘অয়োময়’ লিখছি। কী অসম্ভব কথা!
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এক অংশ তিন তালাকের একটি দৃশ্যেও খুব আহত হলেন। আমি দেখিয়েছিলাম রাগের মাথায় তিনবার ‘তালাক’ বললেই তালাক হয় না। তাঁরা বললেন–হয়। অথচ আমি খুব ভালোমতো জেনেশুনেই নাটকে এই দৃশ্য ব্যবহার করেছি। মুসলিম পারিবারিক আইনেও বলা আছে–পরপর তিনবার তালাক বললেই তালাক হবে না। এই আইন বড় বড় আলেমদের সাহায্যে হাদিস কোরআন ঘেঁটে তৈরি করা। আমার বিপক্ষে কঠিন কঠিন সব চিঠি একের পর এক ছাপা হতে লাগল। হায়, একজন কেউ আমার পক্ষে একটি কথা বললেন না।
শেষ কথা
রচনাটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। এখন শেষ করা উচিত। সুন্দর কিছু কথা বলে শেষ করলে ভালো হতো। অন্য ধরনের কিছু কথা দিয়ে শেষ করি–
নাটকের চতুর্থ পর্ব প্রচারের পর আমার স্ত্রী একটি অসম্ভব রূপবান ছেলের জন্ম। দিলেন। ছেলেটি দু’দিন বেঁচে রইল, তৃতীয় দিনের দিন মারা গেল। শোক ও দুঃখে পাথর হয়ে যাওয়া স্ত্রীকে নিয়ে ঘরে ফিরেছি। বাচ্চারা চিৎকার করে কাঁদছে। আমার মা’কে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আর আমি কী করছি–মাথা নিচু করে লিখে যাচ্ছি অয়োময়ের নবম, দশম পর্ব। আমি দু’দিন পর আমেরিকা চলে যাব। আমাকে পাণ্ডুলিপি দিয়ে যেতে হবে। নাটক যেন বন্ধ না হয়–’Show must go on.’
লিখতে লিখতে হঠাৎ কী মনে হলো। বিছানায় শুয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকালাম। দেখি সে জলভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে, এই পাষাণ হৃদয় মানুষটির সঙ্গে আমার বিয়ে হলো?
আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। মাথায় হাত রাখলাম না। সান্ত্বনার কথাও কিছু বললাম না। আমার হাতে সময় নেই। আমার কাজ শেষ করতে হবে
‘I have promises to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep.’
একদিন আমার সব কাজ শেষ হবে। চাঁদনী পহর রাতে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হব। তখন এ জীবনে সঞ্চিত সমস্ত ব্যথার কথা ভেবে চিৎকার করে কাঁদব। আজ আমার কাঁদার অবসর নেই। have promises to keep.
নামধাম
মানুষের প্রথম পরিচয় তার নাম। দ্বিতীয় পরিচয় কি ‘ধাম’? নামধাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয় বলেই এই জিজ্ঞাসা। আমি মনে করি না নামধাম মানুষের পরিচয়। চুরুলিয়াতে কাজী নজরুল নামের আরেকজন থাকলেই দুই নজরুলের এক পরিচয় হবে না। যদিও তাদের নামধাম এক।
নাম বিষয়ে আজকের লেখা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি। সুরা বাকারায় আল্লাহপাক বলছেন, “আমি আদমকে প্রতিটি বস্তুর নাম শিখিয়েছি।” এখানে ‘নাম’ নিশ্চয়ই প্রতীকী অর্থে এসেছে। নাম হলো বস্তুর property বা ধর্ম। আল্লাহপাকের অনুগ্রহে আল্লাহপাক যে জ্ঞান আদমকে দিলেন সব ফেরেশতা তা থেকে বঞ্চিত হলো।
আমরা মানব সন্তানরা বস্তুর নাম জানি। আগ্রহ নিয়ে নতুন নতুন নাম দেই। গ্যালাক্সির নাম দিলাম ‘এনড্রমিডা’। মঙ্গলগ্রহের দুই চাঁদের একটির নাম দিলাম ‘ডিমোস’, আরেকটি ‘ফিবোস’।
কিছু কিছু নাম আমরা আবার বাতিলও করে দেই। উদাহরণ ‘মীরজাফর’। বাংলাদেশের কোনো বাবা-মা ছেলেমেয়ের নাম ’মীরজাফর’ রাখবে না। মীরজাফর এবং বিশ্বাসঘাতকতা আজ সমার্থক। মীরজাফরের চেয়েও বড় বিশ্বাসঘাতক ছিল সিরাজের হত্যাকারী মিরন। তার প্রতি আমাদের তেমন রাগ নেই যেমন আছে মীরজাফরের প্রতি। মিরন নাম নিষিদ্ধ না, কিন্তু মীরজাফর নিষিদ্ধ, কেন?
কুখ্যাতদের নামে বাবা-মা তাদের সন্তানদের নাম রাখেন না, আবার অতি বিখ্যাতদের নামেও রাখেন না। ইংল্যান্ডের বাবা-মা’রা তাদের সন্তানের নাম শেক্সপিয়র রাখেন না। আইনস্টাইন নাম রাখা হয় না। তবে আমেরিকার ফার্গো শহরে আমার এক অধ্যাপকের কুকুরের নাম ছিল আইনস্টাইন। তিনি আইনস্টাইনকে সম্মান দেখানোর জন্যে তার প্রিয় কুকুরের এই নাম রেখেছিলেন।
চিন্তায় এবং কর্মে আমেরিকানদের মতো জাতি দ্বিতীয়টি নেই। তাদের দু’টা নামের নমুনা দেই (এই দু’জন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্ডার গ্রাজুয়েট ক্লাসের ছাত্র)।
Mr. Long Frog (TET TIE)
Mr. Brown Fox (খয়েরি শিয়াল)
এখন আমার নিজের নামের জটিলতা বিষয়ে বলি। ১৯৭২ সাল। মা গিয়েছেন বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলতে। টাকা তুলতে পারলেন না। কারণ বাবা কোনো এক অদ্ভুত কারণে মাকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের নমিনি করে যান নি। তিনি নমিনি করে গেছেন তার বড় ছেলেকে। কাজেই আমি গেলাম। আমিও টাকা তুলতে পারলাম না। কারণ বাবা তার ছেলের নাম লিখেছেন শামসুর রহমান। আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমার বাবার অনেক অদ্ভুত স্বভাবের একটি হচ্ছে তিনি কিছুদিন পরপর ছেলেমেয়েদের নাম বদলাতেন। শুরুতে আমার নাম ছিল শামসুর রহমান। তিনি আমার নাম বদলে হুমায়ূন আহমেদ রেখেছেন, কিন্তু এই তথ্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের কাগজপত্রে দিতে ভুলে গেছেন।