আমি চাপা অহংকার নিয়ে বললাম, জি।
ওমর ফারুক বিরক্ত গলায় বললেন, গান লেখার তো আপনি কিছুই জানেন না। মিল কোথায়? সঞ্চারী কোথায়?
সঞ্চারী কোথায় আমি জানি না। কিন্তু মিল তো আছে।
এই মিলে চলবে না।
আমি নরম স্বরে বললাম, কী করে গান লিখতে হয় আপনি শিখিয়ে দিন। আমি দ্রুত শিখতে পারি।
ওমর ফারুক সাহেব শিখিয়ে দিলেন। তাঁর মতো করে গান লিখে দিলাম। তিনি সুর দিয়ে আমাকে শোনালেন। আমি অবিকল তাঁর মতো চোখ কপালে তুলে বললাম, কী সুর দিয়েছেন? শুনতে জঘন্য লাগছে।
কী বললেন, শুনতে জঘন্য লাগছে?
জি।
এই রকম কথা বলতে পারলেন?
আমি মনে কথা রাখতে পারি না। যা মনে আসে বলে ফেলি।
হুমায়ুন সাহেব, আপনার সঙ্গে আমি কাজ করব না। স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
উনি এক দরজা দিয়ে বের হচ্ছেন, আমি অন্য দরজা দিয়ে। নওয়াজীশ ভাই দুজনকে ধরে এনে মিটমাট করার চেষ্টা করলেন।
ওমর ফারুক সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, হুমায়ুন সাহেব, গানগুলি প্রচার হোক, তখন আপনি বলবেন–ওমর ফারুক দি গ্রেট।
গান প্রচার হলো। এ দেশের মানুষ গানগুলো ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। আমি বলতে বাধ্য হলাম–ওমর ফারুক দি গ্রেট।
অয়োময়ের সবকটি গান আমার লেখা নয়। একটি লিখেছেন সালেহ চৌধুরী আল্লাহ সবুর করলাম সার। অন্য একটি ওবায়দুল ইসলাম—আসমান ভাইঙা জোছনা পড়ে।
অয়োময়ের গানগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গান হচ্ছে আমার মরণ চাঁদনী পহর রাইতে যেন হয়। আসলেই আমি চাঁদনী পহর রাতের ফকফকা জ্যোৎস্নায় মরতে চাই। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তেও অসহ্য সুন্দর পৃথিবীকে দেখে যেতে চাই। লেখাটা মনে হয় অন্যদিকে মোড় নিয়ে নিচ্ছে, আগের জায়গায় ফিরে যাই।
যাত্রা শুরু
আউটডোরের কাজ হবে ময়মনসিংহে। ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদী, আমিন ডাক্তার নৌকায় করে ভাটি অঞ্চলে যাচ্ছেন– সারা দিন নৌকা চলেছে। একসময় রাত নামল। আকাশে চাঁদ উঠল। বদরুল গান শুরু করল—
‘আসমানে উইঠাছে চান্দি
আমি বসিয়া কান্দি
ভব সমুদ্র একা একা ক্যামনে হব পার?’
দৃশ্যটি ধারণ করতে ক্যামেরাম্যান নজরুল সাহেব হিমশিম খেয়ে গেলেন। নদীতে প্রবল স্রোত। নৌকা টালমাটাল করছে। নেমেছে বৃষ্টি। ময়মনসিংহের বিখ্যাত বৃষ্টি, একবার শুরু হলে থামার নাম করে না।
রাত তখন একটা। গানের দৃশ্যের চিত্রায়ন শুরু হয়েছে। আমি উৎসাহদাতা হিসেবে অন্য একটি নৌকায় আমাদের আর্ট ডাইরেক্টরের সঙ্গে বসে আছি। হঠাৎ প্রবল স্রোতে নৌকা এগিয়ে চলল। মূল দলের সঙ্গে বিছিন্ন হয়ে আমরা ভেসে যেতে লাগলাম। ঘোর অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না–দূর থেকে ভেসে আসছে বদরুলের। গলা (সুবীর নন্দী)–’ভব সমুদ্র একা একা ক্যামনে হব পার।’
আমার জীবনের আনন্দময় মুহূর্তের একটি। আবেগে চোখে পানি এসে গেল। কয়েক ফোঁটা চোখের জল রেখে এলাম ব্রহ্মপুত্র নদীতে।
শুটিং শেষ হলো রাত দুটার দিকে। উৎসাহের কারও কোনো কমতি নেই। ভোর হওয়ামাত্র আবার বের হয়ে পড়লোম। রাজবাড়িতে সেট পড়েছে। পুকুরঘাটে বড় বউ এবং এলাচি বেগম। সারা দিন কাজ হলো। সবার মনে প্রবল উৎসাহ। যে-করেই হোক একটা ভালো জিনিস করতে হবে। যে-কোনো মূল্যে করতে হবে। আশপাশের সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
কত সুখস্মৃতি
‘অয়োময়’ নিয়ে চমৎকার সব স্মৃতি আছে। কয়েকটা বলি।
মীর্জা সাহেব খবর পেলেন তার সন্তান হবে। মনের আনন্দে তিনি সব পাখি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্যামেরা তার মুখের ওপর ধরা। তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। তিনি পাখির খাঁচায় হাত ঢুকাচ্ছেন, আর পাখিরা তাকে প্রাণপণ শক্তিতে ঠোকরাচ্ছে। হাত রক্তাক্ত। মীর্জা সাহেব ব্যথায় চিৎকার করতে পারছেন না–আবার পাখি জোগাড় করা সমস্যা। ছবি নেওয়া শেষ হলো। তিনি বক্তাক্ত হাত চেপে ধরে চেঁচাতে লাগলেন–বাবা রে, মা রে, গেলাম রে!
নাপিত নিবারণকে পাগল তাড়া করছে–নিবারণ ছুটছে। একসময় সে বুকে হাত দিয়ে বসে গেল। নওয়াজীশ আলী খান ছুটে গেলেন। নির্ঘাৎ হার্ট অ্যাটাক। নিবারণরূপী এ.বি সিদ্দিক ছটফট করছেন, তাঁকে হাওয়া করা হচ্ছে, মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। আমি একটু দূরে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি। নওয়াজীশ ভাইয়ের মুখ ছাইবর্ণ। মোবারক উচ্চস্বরে কলেমা শাহাদৎ পড়ছে।
দারোগা সাহেব ঘোড়ায় করে এসেছেন। কাশেমকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবেন। ঘোড়ার পেছনে একদল গ্রামবাসী। গ্রামবাসীর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্যে এক যুবক এগিয়ে এল, সে রীতিমতো পাংক। মাথা কামানো–মাঝখানে এক চিলতে চুল। নওয়াজীশ আলী খানের মেজাজ গেল বিগড়ে। তিনি তাকে নেবেন না। ছেলে অভিনয় করবেই। শেষ পর্যন্ত রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে তুমি আসো ঘোড়ার পেছনে পেছনে। ছেলে দু পা এগুতেই ঘোড়া প্রচণ্ড লাথি দিয়ে ছেলেকে শুইয়ে দিল। আমরা বললাম–সাবাস ঘোড়া। পাংকবিহীন দৃশ্য ধারণ করা হলো।
দুঃখময় স্মৃতি
আমার সব ধারাবাহিক নাটকে যা হয়–একদল মানুষ ক্ষেপে যান। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমাকে নারীবিদ্বেষী হিসেবে দেখানো হলো। কঠিন সব চিঠি ছাপা হলো। একটি লিখলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈকা অধ্যাপিকা। একটি সংলাপে মীর্জার মা’র চরিত্রে রূপদানকারী মিসেস দিলারা জামানও আপত্তি করলেন। সংলাপটি হচ্ছে, ঢোল, পশু ও নারী–এদের সব সময় মারের উপর রাখতে হয়।