কারা কারা অভিনয় করবেন মোটামুটি ঠিক হয়ে গেল। সবাই পূর্বপরিচিত। তাঁদের সঙ্গে আগে কাজ করেছি। নতুনের মধ্যে আছেন মোজাম্মেল হোসেন। একদিন নওয়াজীশ আলী খানের অফিসে গিয়ে দেখি বিশালদেহী এক ভদ্রলোক বসে আছেন। নওয়াজীশ ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন–ইনি অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন। তাকে মীর্জার লাঠিয়াল চরিত্রে ভাবছি।
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। অধ্যাপক মানুষ, সামান্য লাঠিয়াল চরিত্র করবেন? চরিত্রও তো তেমন কিছু না। আমি বললাম, ভাই আপনি কাশতে পারেন? তিনি তৎক্ষণাৎ খুক খুক করে দেখিয়ে দিলেন—’ফলেন পরিচয়তে’।
অয়োময়ের অল্প কিছু ব্যাপার দর্শকরা খুব আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করেছেন—হানিফের কাশি তার একটি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকা হয় কাশার জন্য।
শিল্পীরা অনুষ্ঠানে গান গায়, নাচেন, কবিতা আবৃত্তি করেন হানিফ সাহেব কাশেন। সেদিন শুনলাম এক ক্যাসেট কোম্পানি হানিফ সাহেবের কাশির একটা ক্যাসেট বের করতে চান। এই বিচিত্র দেশে সবই সম্ভব।
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মদিনা চরিত্রে। আমি নওয়াজীশ ভাইকে বলে দিয়েছিলাম–পাগলের থাকবে অল্পবয়স্কা রূপবতী এক বালিকা বধূ। যে মেয়েকে নেওয়া হলো তার নাম মনে পড়ছে না–সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্রী। চরিত্রের জন্যে মানানসই। একদিন রিহার্সেল দিয়ে সে পিছিয়ে পড়ল। জানাল–নাটক করবে না। শান্তাকে ভাবা হলো। তিনিও পিছিয়ে পড়লেন। দেখা গেল এই চরিত্র কারোরই পছন্দ নয়। একটা সমস্যায় পড়া গেল।
আহমেদ ছফা তখন এক মহিলাকে পাঠালেন যদি তাকে কোনো সুযোগ দেওয়া যায়। তার সঙ্গে কথা বলে আমার ধারণা হলো, তিনি পারবেন। আমি তাকে নিয়ে টিভি ভবনে গেলাম। ভদ্রমহিলা বললেন, হুমায়ূন ভাই, যেহেতু আপনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন আমার একটি চরিত্র পাওয়া অবশ্যই উচিত, কিন্তু আমার সিক্সথ সেন্স অত্যন্ত প্রবল। আমি জানি এই নাটকে অভিনয় করতে পারব না।
মহিলা রিহার্সেলে অংশগ্রহণ করলেন। কন্ট্রাক্ট ফরমে সই করলেন। আমি তাকে হাসিমুখে বললাম, দেখলেন তো আপনার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল নয়।
তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, তাই তো দেখছি, কিন্তু আমি জানি আমার দ্বারা হবে না। বিশ্বাস করুন, আমার সিক্সথ সেন্স অত্যন্ত প্রবল।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ভদ্রমহিলার কথাই শেষ পর্যন্ত সত্য হলো। তাকে নেওয়া হলো না। কেন নেওয়া হলো না তা তাঁকে বলা উচিত ছিল। বলিনি। আজ এই লেখার মাধ্যমে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং স্বীকার করছি, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আসলেই ভালো।
মদিনা চরিত্রে শেষ পর্যন্ত এলেন–তারানা। আমি সবসময় তার অভিনয়ের ভক্ত। ‘বহুব্রীহি’ নাটকে তাকে নেওয়ার খুব আগ্রহ ছিল। তিনি রাজি হননি। এইবার রাজি হলেন।
অয়োময় হবে না
সব যখন ঠিকঠাক তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের পক্ষ থেকে নওয়াজীশ আলী খান আমাকে জানালেন, অয়োময় করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম কারণ কী?
তিনি করুণ গলায় বললেন, কারণ খুব সহজ। টিভির অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এই নাটক যা দাবি করছে টিভিতে পক্ষে তা মেটানো সম্ভব নয়। হাতি, ঘোড়া, ছিপ নৌকা, হাওড়ে দিনরাত শুটিং–অসম্ভব। এই একটি ধারাবাহিকের জন্যে টিভির পক্ষে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়। কাজেই বাতিল।
আমি মন খারাপ করে বাসায় বসে রইলাম। আমাকে আরেকটি সহজ নাটক লিখে দেওয়ার জন্য মুস্তাফিজুর রহমান অনুরোধ করলেন। আমি বালকদের মতো অভিমানী গলায় বললাম, না।
আমি যখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে নাটক হবে না, তখন একদিন নওয়াজীশ আলী খান বললেন, সুসংবাদ। টিভি এই নাটকের জন্যে কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে রাজি হয়েছে, তবে আপনাকেও আপনার পরিকল্পনার খানিকটা কাটছাঁট করতে হবে। রাজি থাকলে চলুন নৌকা ভাসিয়ে দেই।
আমি বললাম, রাজি। খুশি মনে বাসায় ফিরে এসেছি। গুলতেকিনকে বললাম, আয়োময় শেষ পর্যন্ত যাচ্ছে। সে ফ্যাকাশে ভঙ্গিতে হাসল। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে বলল, আচ্ছা আমি যদি তোমাকে কোনো অনুরোধ করি তুমি রাখবে?
আমি বললাম, অবশ্যই রাখব। কী চাও তুমি?
নাটকটি তুমি এক বছর পিছিয়ে দাও।
সে-কি! কেন?
আমি বেবি এক্সপেক্ট করছি। এই অবস্থায় টেনশন নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব। আমি তোমার নাড়ি-নক্ষত্র চিনি। নাটক শুরু হওয়ামাত্র তুমি জগৎ-সংসার ভুলে যাবে। সব সামলাতে হবে আমাকে। আমার পক্ষে তা সম্ভব না। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, একটা বছর পিছিয়ে দাও।
আমি বললাম, তা তো সম্ভব না। পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে, খেলা শুরু হয়েছে। তুমি কোনো চিন্তা করবে না। তোমাকে কোনো টেনশন নিতে হবে না–সব টেনশন আমি নেব।
গুলতেকিনের কথা না-শোনার জন্য পরবর্তী সময়ে আমাকে চরম মূল্য দিতে হলো। সেই গল্প একটু পরেই বলব।
অয়োময়ের গান
গান লিখব কখনো ভাবি নি। আমার সবসময় মনে হয়েছে, গীতিকার হওয়ার প্রথম শর্ত সুর, রাগ-রাগিণীর উপর দখল। সেই দখল আমার একেবারেই নেই। কাজেই গান লেখার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু গান তো লাগবেই। ভাটি অঞ্চলের মানুষ ছ’ মাস বসে থাকে। সেই সময়ের বড় অংশ তারা গান-বাজনা করে কাটায়। অয়োময় ভাটি অঞ্চলের গল্প। গান ছাড়া চলবে না। প্রথমে ভেবেছিলাম সেই অঞ্চলের প্রচলিত গীত ব্যবহার করব। সংগ্রহ করা গেল না। শেষটায় বিরক্ত হয়ে নিজেই লিখতে বসলাম। সুর দেওয়ার জন্য ওমর ফারুককে দেওয়া হলো। তিনি চোখ কপালে তুলে বললেন, আপনার লেখা?