প্রথম পাণ্ডুলিপি পাঠ
আমার জীবন বন্ধুহীন। মাঝে মাঝে অল্প কিছু সময়ের জন্য দু’একজন বন্ধু-বান্ধব জোটে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ এক বছরের বেশি কখনো থাকে না। আমার তেমনি এক বন্ধু কবি ওবায়দুল ইসলাম আগ্রহ প্রকাশ করলেন যে, প্রথম পাণ্ডুলিপি তার বাসায় পাঠ হবে। সেই উপলক্ষে অনেককে নিমন্ত্রণ করা হলো। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আছেন–আবুল খায়ের, আসাদুজ্জামান নূর, ড. এবং মিসেস এনামুল হক, সপরিবারে আবুল হায়াত। আসরের মধ্যমণি হিসেবে আছেন নওয়াজীশ আলী খান। খাবারদাবারের বিপুল আয়োজন। পাণ্ডুলিপি পকেটে নিয়ে সন্ধ্যার পর সেই বাসায় উপস্থিত হলাম। অতিথিরা সবাই এসে গেছেন, কিন্তু তাদের সবার মুখই শুকনো। কথা বলছেন নিচু গলায়। খবর যা শুনলাম তা ভয়াবহ। ওবায়দুল ইসলাম সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র খেলতে গিয়ে বা চোখে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। চোখে দেখতে পাচ্ছে না বলে বলছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তার বলেছেন, চোখের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিছুমাত্র নড়াচড়া না করে দু’সপ্তাহ একভাবে শুয়ে থাকতে হবে। ভাগ্য ভালো হলে রক্ত শরীর শুষে নেবে। ভাগ্য খারাপ হলে…
ছেলেটি শুয়ে আছে। নড়াচড়া করছে না। এই অবস্থায় খাওয়াদাওয়া করা বা পাণ্ডুলিপি পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি বললাম, আজ বাদ থাক, অন্য একদিন পড়া যাবে। নওয়াজীশ আলী খান বললেন, বাদ দিন, বাদ দিন।
গৃহকর্তা এবং গৃহকত্রী রাজি হলেন না। তাঁদের বাড়ির সবাই অভিনয়কলায় বিশেষ পারদর্শী। সবাই এমন ভাব করতে লাগলেন যেন কিছুই হয়নি। চোখে আঘাত পেয়ে দেখতে না-পাওয়া যেন নিত্যদিনের ব্যাপার। তাদের কারণেই খাওয়াদাওয়া হলো, পাণ্ডুলিপি পাঠ হলো। তর্ক-বিতর্ক, মন্তব্য, রসিকতা চলতে লাগল। একসময় বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলাম, মরার মতো পড়ে থাকা বাচ্চাছেলেটির কথা কারোরই মনে নেই। প্রথম দিনের আলোচনায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আমিন ডাক্তারের ভূমিকায় অভিনয় করবেন জনাব আবুল খায়ের। নাটকটির নাম বদল করা হবে।
অভিনেতা–অভিনেত্রী নির্বাচন
নাটকের পাত্র-পাত্রী নির্বাচন সবসময় প্রযোজকই করে থাকেন। নওয়াজীশ আলী খান বললেন, নির্বাচনের ব্যাপারটি আপনাকে নিয়ে করতে চাই। এই নাটকে চরিত্র অনেক বেশি। চরিত্রের মেজাজও বিচিত্র। আপনি সঙ্গে থাকলে ভালো হবে।
আমি সঙ্গে রইলাম। দেখা গেল, আমি সঙ্গে থাকায় সমস্যা কমল না, বাড়ল। পছন্দের অভিনেতা-অভিনেত্রী যাকেই নিতে চাই তিনিই না করেন। মদিনার স্বামী হিসেবে মামুনুর রশীদকে নেওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। তিনি দ্রভাবে বললেন–না। মীর্জার ছোট বউ হিসেবে খুব শখ ছিল সুবর্ণাকে নেওয়ার। তিনি বললেন–না। তার না বলার কারণ হচ্ছে, তিনি অন্য একটি ধারাবাহিক নাটক ‘গ্রন্থিকগণ কহে’-তে কথা দিয়ে রেখেছেন। ডলি জহুরকেও বলা হলো। তিনি বললেন, মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের একটি সিরিজে ভাঁকে কাজ করতে হবে। শান্তা ইসলামকে মদিনার চরিত্রে ভাবা হয়েছিল, তার চরিত্র পছন্দ হলো না। বললেন–বিদেশ যাবেন, কাজেই করতে পারবেন না।
আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু জনাব আবুল হায়াত সাহেবকে যখন কাশেমের চরিত্র করতে বলা হলো তখন তার ফর্সা মুখ কালো হয়ে গেল। চরিত্র পছন্দ নয়। তাকে বাসায় গিয়ে নানান কথাবার্তায় ভোলাতে হলো।
ফেরদৌসী মজুমদারকে মা চরিত্রে ভাবা হলো। আমি নিজে এক দুপুরে তাকে পরপর তিনটি পর্ব পড়ে শোনালাম। তিনি শুকনো গলায় বললেন, এর মধ্যে অভিনয় করার কী আছে? যে-কেউ এই চরিত্র করতে পারে।
সাবিহা চরিত্রে মধ্যম মানের একজন অভিনেত্রীকে ডাকা হয়েছিল (ডালিয়া)। তিনিও শুকনো মুখে জানালেন, চরিত্রে অভিনয়ের কিছু নেই।
শেষ পর্যন্ত চরিত্র ঠিক হলো।
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম শুনে সবাই বলল–ডুবেছে, এইবার হুমায়ুন। আহমেদ ডুবেছে। বিশ বাঁও পানির নিচে পড়ে যাবে। তাদের এ-জাতীয় চিন্তার কারণ হচ্ছে–মীর্জা চরিত্র করছেন আসাদুজ্জামান নূর। যিনি সবসময় হালকা আমোদী ধরনের চরিত্র করেন। মীর্জা চরিত্রের কাঠিন্য আনা তাঁর কর্ম নয়।
দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র করছেন সারা যাকের। টিভি দর্শকরা যাকে আগে কখনো পছন্দ করেননি।
আরেকটি প্রধান চরিত্র করছেন আমজাদ হোসেন। সবার ধারণা হলো, তিনি উচ্চগ্রামের অভিনয় করে নাটকে ‘আউলা’ ভাব নিয়ে আসবেন।
হায়াত সাহেবকে নিয়েও ভয়–মাঝি চরিত্রে তাকে মানাবে না।
মুস্তাফিজুর রহমান আমাকে বললেন, মিসকষ্ট হয়েছে। মিসকাস্টের জন্যে সমস্যায় পড়বেন। এখনো সময় আছে নূরের জায়গায় আলী যাকেরকে নিন। বিশাল দেহ আছে, মানিয়ে যাবে।
আমি বললাম, জমিদারকে কুস্তি করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই দেখা যাক না।
নৌকা ভাসানোর ব্যবস্থা হলো। ছটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হলো এবং পাঠ করা হলো। একেকদিন একেকজনের বাসায়। যে বাড়িতে পাঠ করা হবে সেই বাড়ির দায়িত্ব হচ্ছে চমৎকার ডিনারের ব্যবস্থা করা। আমি পাণ্ডুলিপি নিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে খেয়ে বেড়াতে লাগলাম। সে বড় সুখের সময়।
ইতিমধ্যে নাম বদল হয়েছে। এখন আর আমিন ডাক্তার নাম নয়। এখন নাম হলো ‘অয়োময়’।
এই অদ্ভুত নাম কোথায় পেলাম। দেশ পত্রিকায় একবার একটা কবিতা পড়েছিলাম। কবির নাম অয়োময় চট্টোপাধ্যায়। অয়োময় নামটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। গাঁথুনি থেকে খুলে নিয়ে খানিকটা হালকা করলাম।