এখন বলি এগারো এবং তেত্রিশ এই লেখায় হঠাৎ কেন আনলাম। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে জিতবে এবং আমরা তেত্রিশবার তোপধ্বনি করব। এই ভেবেই তেত্রিশ তোপধ্বনি প্রসঙ্গ। হ্যালো, বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা! আমরা কিন্তু তেত্রিশটা কামান নিয়ে বসে আছি!
অয়োময়
বেদনা ও আনন্দময় অভিজ্ঞতার গল্প
নিউমার্কেটে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সৈয়দ শাসুল হকের সঙ্গে দেখা। তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, কী লিখছেন?
আমি বললাম, ‘অয়োময়’ লিখছি।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, সাহিত্য কিছু লিখছেন না?
এই দিয়েই ‘অয়োময়’ প্রসঙ্গ শুরু করি। তবে শুরুর আগে বলে নিই, সৈয়দ হকের এই কথায় আমি আহত হয়েছি। টিভির জন্যে নাটক লিখলে সাহিত্য হবে না, মঞ্চের জন্যে লিখলে সাহিত্য হবে, এই অদ্ভুত ধারণা তিনি কোথায় পেলেন কে বলবে। যে ‘অয়োময়’ আমি টিভিতে দিচ্ছি মঞ্চে তা দিয়ে দিলেই সাহিত্য হয়ে যাবে? আমি কেমিস্ট্রির ছাত্র, এইসব ব্যাপার বুঝি না, তার মতামত মেনে নিয়েই (!) আজকের লেখা শুরু করি।
অয়োময়ের আগে আরও দুটি অসাহিত্য’ টিভির জন্যে লিখেছিলাম–এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি। বহুব্রীহি শেষ করার পর একটা বড় কাগজে লেখলাম–এই জীবনে আর ধারাবাহিক নাটক লিখব না। আমার বড় কন্যা সেই লেখা ফ্রিজের গায়ে আটকে দিল। ঠান্ডা পানির জন্যে যতবার ফ্রিজের দরজা খুলি ততবার লেখাটার দিকে চোখ পড়ে। একসময় মনে হলো সেলফ হিপনোসিস প্রক্রিয়া কাজ করছে–মাথা থেকে ধারাবাহিক নাটকের ভূত নেমে গেছে। ফ্রিজের গা থেকে লেখা তুলে ফেলা হলো। আমি অন্য লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বছর দুই কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ লক্ষ করলাম মাথার গভীর গোপনে এক ধরনের যন্ত্রণা বোধ করছি। যন্ত্রণার কারণ ঠিক বুঝতে পারছি না। স্ত্রী এবং তিন কন্যাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলাম। গারো পাহাড় দেখতে যাব, পথে ময়মনসিংহ শহরে থাকলাম। বিকেলে দেখতে গেলাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। মুক্তাগাছার জমিদারের বসতবাড়ি। কলেজের শিক্ষকরা খুব আগ্রহ নিয়ে সব ঘুরে দেখালেন। রাজবাড়ির চারদিকে বিচিত্র সব গাছ। তারা এইসব গাছপালা খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে চেনাতে লাগলেন।
এটা এলাচি গাছ, এটা লবঙ্গ গাছ, এটা দারুচিনি গাছ।
মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল–এলাচি, লবঙ্গ, দারুচিনি।
তারা নিয়ে গেলেন পুকুর ঘাটে। কী সুন্দর ডিমের মতো পুকুর। শ্বেত পাথরের কী চমৎকার বাঁধানো ঘাট! পানিতে পা ডুবিয়ে ঘাটে বসেছি। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিল্পকলার শিক্ষক জমিদার সম্পর্কে মজার মজার গল্প বলছেন, মুগ্ধ হয়ে শুনছি—
বুঝলেন হুমায়ুন সাহেব, এই জমিদারের তিন স্ত্রী ছিলেন। তাদের একজন বিষ খাইয়ে স্বামীকে হত্যার চেষ্টা করেন। জমিদার সাহেব অনেক চেষ্টা করেন বের করতে–তিনজনের ভেতর কে বিষ দিয়েছে। বের করতে পারেন না। তিনি স্ত্রীদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। নতুন ধরনের শাস্তি। তিন স্ত্রীকে সামনে নিয়ে তিনি বসলেন। একটা বিড়ালকে বিষ খাইয়ে তাদের সামনে রাখলেন। তারা দেখলেন কী করে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বিড়াল মারা যায়। জমিদার স্ত্রীদের চোখের দিকে। তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। এই ঘটনা মাসে একবার করে ঘটতে লাগল।
গল্প শুনে আমি মুগ্ধ। চট করে মাথায় এল–আচ্ছা এদের নিয়ে একটা লেখা লিখলে কেমন হয়? কিন্তু এদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। কেমন ছিল তাদের জীবনচর্যা। পুরোপুরি কল্পনাকে আশ্রয় করে এখোনো কি ঠিক হবে? গবেষণা করব, এত সময় কোথায়?
কখনো যা করি না তা-ই করলাম, ঠিক করলাম কিছু খাটাখাটনি করব, তথ্য জোগাড় করব। ভাটি অঞ্চলের জমিদারদের জীবিত বংশধরদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম–তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। এদের মধ্যে আছেন গচিয়া চৌধুরী বাড়ির সালেহ উদ্দিন চৌধুরী এবং বাজিতপুর জমিদার বাড়ির বংশধর হারুনুর রশীদ। খসড়া লেখা তৈরি হলো—পরিকল্পনা উপন্যাস লেখার। ধারাবাহিক নাটকের চিন্তা তখনো মাথায় আসে নি।
নওয়াজীশ আলী খান
এক দুপুরে টিভি থেকে টেলিফোন করলেন নওয়াজীশ আলী খান। মহা আনন্দিত। আনন্দের কারণ হচ্ছে, তাঁকে টিভি থেকে সরিয়ে নিমকো বা এই জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে নির্বাসিত করা হয়েছিল, তিনি আবার টিভিতে ফিরে এসেছেন। তিনি বললেন, হুমায়ূন ভাই, আসুন চা খেয়ে যান। অনেক দিন আপনার পাগলামি কথাবার্তা শুনি না। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে আমার পাগলামি কথাবার্তা শোনাবার জন্যে রওনা হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, একটা ধারাবাহিক নাটক করলে কেমন হয়?
আমি বললাম, উত্তম হয়। কিন্তু আমি তো ভাই প্রতিজ্ঞা করেছি, আর ধারাবাহিক নাটকে যাব না।
প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবেন না?
জি-না।
প্রতিজ্ঞা করা হয় ভাঙার জনো, এটা জানেন?
জানি।
তাহলে আসুন শুরু করা যাক।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আপনার উপন্যাসকে ভিত্তি করে একটা ধারাবাহিক নাটক করি–বড় উপন্যাস আছে?
না, তবে যে-কোনো উপন্যাসকেই আমি টেনে রাবারের মতো লম্বা করতে পারব।
তাহলে একটা নাম দিন, এবং সিনপসিস দিন–আজই টিভি গাইডে যাবে।
আমি নাম দিলাম, ‘আমিন ডাক্তার’। একটা সিনপসিসও লিখে দিলাম–সেই সিনপসিস এমন যে, পড়ে কেউ কিছুই বুঝবে না। বাসায় ফিরেই ধারাবাহিক নাটকের প্রথম পর্বটি লিখে ফেললাম। লেখা শেষ হলো রাত তিনটার দিকে। গুলতেকিনকে পড়তে দিলাম। সে পড়ে বলল, নাটকের নাম আমিন ডাক্তার, কিন্তু গল্প তো দেখা যাচ্ছে জনৈক ছোট মীর্জাকে নিয়ে। আমি বললাম, শুরুতে আমিন ডাক্তার অপ্রধান চরিত্রে থাকলেও শেষটায় ঝলসে উঠবেন। গুলতেকিন বলল, নাটক ভালো হয়েছে, তবে নামটা পছন্দ হচ্ছে না। আমি বললাম, যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বলবে না। সে বলল, পৃথিবীর সবকিছু তুমি বোঝ আর কেউ কিছু বোঝে না এটা মনে করারও কোনো কারণ দেখি না। দুজন দুপাশে ফিরে ঘুমুতে গেলাম।