ইনডোরের শুটিং হতো দুদিন। দ্বিতীয় দিনেই শুরু হতো তাড়াহুড়া। শেষ ঘণ্টা বাজার আগে দেখা যেত আট-নটি দৃশ্য ধারণ করা হয় নি। পরিচালক মাথায় হাত দিতেন।
বিটিভি জমানায় (অন্য কোনো চ্যানেল যে জমানায় আসে নি, সেই জমানা) ঈদের দিন ঘুম ভাঙার পর থেকেই আমি আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকতাম। রাতে নাটক আছে। না জানি কেমন হবে? যাদের জন্যে নাটক বানানো হয়েছে, তারা পছন্দ করবে তো? প্রাণ খুলে হাসবে তো? আনন্দ পাবে তো? অসহনীয় টেনশনে ঈদ হয়ে যেত ভয়ঙ্কর।
এরপর বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক নোংরা এবং বিষাক্ত পানি প্রবাহিত হয়েছে, আমার জন্যে ঈদ ভয়ংকরই থেকে গেছে।
আগে একটা নাটক লিখতাম। টেনশন এক নাটকে সীমাবদ্ধ থাকত। এখন এক ঈদে পাঁচটা-ছ’টা করে নাটক লিখতে হয়। আমি নিজে প্রচারের দিন কোনো নাটকই দেখতে পারি না। কোনটা দেখব? দর্শকরাও নাটক দেখেন না। তারা দেখেন বিজ্ঞাপন। ‘লেড়কা সে লেড়কাকা গু ভারী’র মতো নাটকের চেয়ে বিজ্ঞাপন ভারী হয়ে গেছে।
আমি কঠিন প্যাঁচে পড়েছি। গোদের উপর ক্যান্সারের মতো ঈদের নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঈদসংখ্যায় লেখা। আমি রক্তের মধ্যে ক্লান্তি অনুভব করছি।
ক্লান্ত চোখ ও ক্লান্ত চোখের পাতা
তাহার চেয়েও ক্লান্ত আমার পা।
মাঝ উঠোনে সাধের আসন পাতা
একটু বসি?
জবাব আসে, ‘না’।
একজন আমেরিকানের চোখে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব
এই ক্ষুদ্র দেশটির অবস্থান ভারতের পূর্বে। দেশটির দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। ট্রপিক্যাল জোনের বেনানা বেল্টে এর অবস্থান।
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের জনগোষ্ঠীর নব্বই শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্র্যের সঙ্গে দুর্নীতি সম্পর্কযুক্ত। দুর্নীতিতে শীর্ষ সূত্রে প্রায় প্রতিবারেই এই দেশের নাম আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে (বন্যা, জলোচ্ছাস, খরা) আছে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ। যেমন, জঙ্গি মৌলবাদ। এরা দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে প্রায়ই তারা বোমাবাজি করে। দেশটিতে আমেরিকার মতোই প্রধান দুটি দল। পরস্পরের প্রতি এদের আচরণ অত্যন্ত বিদ্বেষপূর্ণ। যে দল ক্ষমতায় থাকে না, তার প্রধান লক্ষ্য থাকে হরতাল দিয়ে দেশকে অচল করে দেওয়া। হরতাল মানেই দোকানপাট, গাড়ি ভাঙচুর।
গাড়ি ভাঙা এই দেশের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি তুচ্ছ কারণে এরা শত শত গাড়ি ভাঙচুর করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মীরা এই ধরনের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে কখনো হস্তক্ষেপ করেন না।
দেশটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। র্যাব নামের একটি সংস্থা এ দেশে আছে, তারা যে-কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। তার জন্যে তাদের জবাবদিহিতার দিয়ে যেতে হয় না। এইসব হত্যাকাত্রে নাম ‘ক্রসফায়ার’। সঙ্গতকারণেই এদের পোশাক ফাঁসির জল্লাদদের পোশাক। তারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার জন্যে কালো চশমা পরে এবং কালো রুমালে মাথা ঢেকে রাখে।
দেশ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দেওয়া হলো। এখন এই দেশের রাজধানী ঢাকা শহরের মানুষদের বর্ষবরণ উৎসব পালনের কথা বলব। শুরুতেই বলে নিচ্ছি, এই দেশটিতে সরকারিভাবে কিংবা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয় না। এই ক্যালেন্ডারের ব্যবহার বিভিন্ন উৎসবের দিন নির্ধারণে। বাংলা ক্যালেন্ডারে নববর্ষ হলো বৈশাখের প্রথম দিন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এপ্রিলের ১৪ তারিখ।
দিনটি ছিল অসম্ভব গরম। তাপমাত্রা তেত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের প্রখর উত্তাপ। আমি একটা রিকশা নিয়ে বনানী থেকে শহর-কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছি। রিকশা হচ্ছে পেশিশক্তিতে চালিত একটি যান। এদের সচল চিত্রশালাও বলা যায়। কারণ প্রতিটি রিকশার পেছনে বহুবর্ণ পেইন্টিং আছে। আমি যে রিকশায় চড়েছি, সেখানে একটি বাঘের ছবি আছে। বাঘের মাথার উপর দিয়ে প্লেন উড়ে যাচ্ছে। তার সামনে আছে একটা ট্রেন।
আমার রিকশাওয়ালার নাম হামিদ। সে একজন হাসিখুশি যুবক। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সবাই হাসিখুশি। আন্তর্জাতিক একটি জরিপে বাংলাদেশ বিশ্বের সুখী দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থানে স্থান করে নিয়েছে।
আমি হামিদকে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললাম, তুমি আজ আমার গাইড। তুমি আমাকে তোমাদের বর্ষবরণ উৎসব দেখাবে।
হামিদ ইংরেজিতে বলল, ইয়েস স্যার। তার ইংরেজি জ্ঞান ইয়েস এবং নো-তে সীমাবদ্ধ। এতে অবশ্যি আমাদের ভাবের আদান-প্রদানে অসুবিধা হলো না। সে আমার অদ্ভুত বাংলা বুঝতে পারছে।
হামিদ বলল, আপনি স্যার আসল জিনিস মিস দিলেন। সূর্য উঠার আগে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। রমনা বটমূলে। কী সুন্দর গান যে হয়! গান শুনলে চোখে পানি আসে।
তুমি শুনেছ?
তিনবার শুনেছি। তিনবারই চোখের পানি ফেলেছি। প্রথমবার অনেক বেশি, পরের দুইবার কম।
এইবার গান শুনতে যাও নাই কেন?
পেটের ধান্ধায় যাই নাই। ট্রিপে না গেলে ঘরে উপাস থাকব। সংসারে অনেক খানেওয়ালা আমার মা, পরিবার আর দুই মাইয়া।
তারা কোথায়?
সক্কালবেলায় এরারে গান শুনতে নামায়া দিছি। দুপুরে একসাথে পান্তা খাব। এরা সইন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব, তারপর ঘরে ফিরব।
পান্তা জিনিসটা কী?