প্রথম গুজব ছড়ালেন বিলকিস বানু নামের সত্তর বছর বয়সী এক অভিনেত্রী। শুরুর দিকের পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে তিনি সহনায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতেন। একসময় ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়লেন। বৃদ্ধবয়সে তার স্থান হলো এফডিসির গেটে। মোটামুটি ভিক্ষাবৃত্তি। আমি তাঁকে সাহায্য করার জন্যেই ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিতে অভিনয় করার জন্যে ডাকলাম। তার স্থান হলো মূল বাংলোয়, ছবির কলাকুশলীদের সঙ্গে। তখন নুহাশপল্লীতে তেমন কোনো স্থাপনা ছিল না। লিচুতলায় ছিল খুঁটির উপরে কাঠের ঘর। আমি থাকতাম লিচুতলা থেকে কিছুটা দূরে ছোট্ট কাঠের ঘরে। আরেকটা কাঠের ঘর ছিল প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রীদের (শাওন, জাহিদ হাসান, মাহফুজ) জন্যে।
বিলকিস বানু বলা শুরু করলেন, এই অঞ্চল জ্বিনে ভর্তি। এরা সবাই শান্ত প্রকৃতির জ্বিন। ফিল্ম ইউনিটের কারণে এদের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। এরা এখন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। বিলকিস বানুর এই কথার পর অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় জ্বিন দেখা শুরু করল।
লাইটের লোকজন দলবেঁধে আমার কাছে এসে বলল, তারা অনেকগুলি মেয়ের একসঙ্গে খিলখিল হাসি শুনেছে।
জেনারেটরের লোকজন বলল, তারা বাথরুমে যেতে পারে না। বাথরুমের দরজা বন্ধ করলেই দরজায় ধাক্কা পড়তে থাকে। দরজা খুললে দেখা যায় কেউ নেই। জেনারেটর দলের প্রধান বলল, স্যার, আমরা এখানে কাজ করব না। জেনারেটর নিয়ে চলে যাব। আপনি অন্য জেনারেটর নিয়ে কাজ করুন।
আমি জেনারেটরের খোঁজে লোক লাগালাম। এক সন্ধ্যায় গাজীপুরের এক মাওলানা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি আমাকে বললেন, আমি একটা বিশেষ খবর শুনে আপনার কাছে এসেছি। আপনাকে সাবধান করতে এসেছি।
আমি বললাম, বলুন কী খবর শুনেছেন?
রাত ঠিক বারোটার সময় আপনার ঘরের বান্দারায় নাকি চারটা কুকুর এসে শুয়ে থাকে?
আমি বললাম, কুকুরের সঙ্গে তো ঘড়ি নেই যে ঘড়ি দেখে ঠিক বারোটার সময় আসবে। তবে কয়েকটা কুকুর রাতে বারান্দায় শুয়ে থাকে। ভোরবেলা চলে যায়।
এত ঘর থাকতে আপনার ঘরের সামনেই শুয়ে থাকে কেন?
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, এটা তো কুকুরেরা ভালো বলতে পারবে। আমি পারব না।
তার পরেও আপনার ধারণাটা কী?
আমি বললাম, কুকুর কেন আমায় ঘরের বারান্দায় শুয়ে থাকে এটা নিয়ে আমি গবেষণা করতে রাজি না।
মাওলানা বললেন, আপনি মনে হয় আমার কথায় রাগ করেছেন।
আমি বললাম, রাগ করি নাই, তবে বিরক্ত হয়েছি।
মাওলানা বললেন, আমি আর বিরক্ত করব না। রাতে কুকুরগুলা এলে ওদের দেখে চলে যাব।
এত রাতে যাবেন কীভাবে?
আমি রিকশা নিয়ে এসেছি।
ঠিক আছে কুকুর দেখুন। শুটিংস্পটে মানুষজন নায়ক-নায়িকা দেখতে আসে, আপনি কুকুর দেখতে এসেছেন। খারাপ কী!
মাওলানার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের কারণে নিজেরই বেশ মন খারাপ হলো। আমি জ্বিনের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে আছি বলে অন্যের উপর রাগ করার কোনো মানে হয় না। আমি মাওলানাকে আমার সঙ্গে ডিনার করতে বললাম। তিনি রাজি হলেন না। চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আমাকে বললেন, আপনার বারান্দায় যে চারটা কুকুর রাতে এসে থাকে এরা কুকুর না। জ্বিন।
আমি বললাম, ও আচ্ছা। শুনে ভালো লাগল।
জিন একমাত্র প্রাণী যারা ইচ্ছামতো অন্যরূপ নিতে পারে। মানুষের রূপ নেয়। তবে সবচেয়ে পছন্দ করে সাপ ও কুকুরের রূপ নিতে। আমার ধারণা, আপনার ঘরে সাপের রূপ ধরেও কিছু জ্বিন আছে।
আমি বললাম, ভাই, আমার ঘরে কোনো সাপ নাই। সাপ আমি প্রচণ্ড ভয় পাই। ঘরের চারদিকে কার্বলিক অ্যাসিড দেওয়া। আমার খাটের নিচে মুখ খোলা কার্বলিক অ্যাসিডের শিশি। আমার বাথরুমেও কার্বলিক অ্যাসিড।
মাওলানা বললেন, আমি আপনার জন্যে একটা তাবিজ নিয়ে এসেছি। তাবিজটা কি রাখবেন?
আমি বললাম, না।
গলায় বা হাতে পরতে হবে না, আপনার ঘরে ঝুলিয়ে রাখলেই হবে।
আমি আবারও বললাম, না।
মাওলানা মন খারাপ করে চলে যাওয়ার পর মনে হলো তাবিজটা রেখে দিলেও হতো।
নুহাশপল্লীতে জ্বিনবিষয়ক বিশৃঙ্খলা চরমে উঠল। মেকাপম্যান তার অ্যাসিসটেন্টকে নিয়ে কাউকে কিছু না বলে গোপনে পালিয়ে গেল। জেনারেটরের লোকজন আমার কাছে বিদায় নিয়েই গেল। কোন উপায় না দেখে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির শুটিং বন্ধ করে দিলাম। ঘোষণাটসা দেওয়া হলো দুপুরে, সন্ধ্যার মধ্যে নুহাশপল্লী খালি। আমার সঙ্গে আছে দুজন কর্মচারী–নুরুল হক আর রফিক। তখন নুহাশপল্লীতে এই দুজন কর্মচারীই ছিল আমি তাদের বললাম, সবাই চলে গেছে, তোমরা আছ কেন? তোমরাও চলে যাও।
রফিক বলল, আপনি যাবেন না?
আমি বললাম, না।
নুরুল হক বলল, স্যার, আপনি চলে যান। জ্বিনের উপদ্রব কমুক, তারপর খবর দিলে আসবেন।
আমি বললাম, আমি থাকব। জ্বিনের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে। তোমরা চলে যেতে চাইলে চলে যাও। থাকলে থাকো।
রফিক চলে গেল। নুরুল হক আমার সঙ্গে ঝুলে রইল।
রাত ন’টা। নুরুল হক রান্না চড়িয়েছে। আমি লিচু বাগানের বেদিতে বসে আছি। হঠাৎ ঝড়ের মতো উঠল। লিচুগাছের পাতায় বাতাসের শব্দ হতে লাগল। লিচু বাগানে চারটা লিচুগাছ। আমি যে গাছের নিচে বসেছি তার পাতা ও ডাল কাঁপছে, অন্য গাছের পাতায় বাতাসের কাঁপন নেই। ভয়ে আমার কলিজায় কাঁপুনি শুরু হওয়ার কথা, কিছুই হলো না। মনে হয় চিন্তায়, দুঃখে, ক্ষোভে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল।