বাদ থাকুক তত্ত্বকথা, মূল গল্পে আসি।
শুক্রবার। জুমার নামাজের জন্যে দু’ঘণ্টা শুটিং-বিরতি। আমি গাছের ছায়ায় চেয়ারে পা তুলে আরাম করে বসে আছি। মন আনন্দে পরিপূর্ণ। খবর পেয়েছি শাওন ঢাকা থেকে ভোরবেলা তার দুই পুত্রকে নিয়ে রওনা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার। উপস্থিত হওয়ার কথা। দুইপুত্রকে নিয়ে অনেক দিন পর চটকা চটকি করা যাবে।
হঠাৎ বিরাট হইচই।
আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। ফিল্ম ইউনিটে অতি তুচ্ছ ঘটনা লঙ্কাকাণ্ডে রূপ নেয়। মাথা ফাটে, রক্তারক্তি হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব সমাধান। যে যার কাজ করছে। সবাইকে আনন্দিত মনে হয়। কারণ–দুর্ঘটনা ঘটেছে রক্তপাত হয়েছে, ছবি হিট হবে।
হইচইয়ের কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে দেখি, ছবি হিট করার ব্যবস্থা ভালোমতোই সম্পন্ন। ছামাদ মেঝেতে পড়ে আছে। তার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। সে কোনো সাড়াশব্দ করছে না। আমি আঁতকে উঠে বললাম, মারা গেছে নাকি?
ছালাম কোঁকাতে কোঁকাতে বলল, জিন্দা আছি স্যার।
হয়েছে কী?
মোবাইল ফোন চুরি করেছি, এইজন্যে মাইর দিয়েছে।
তুমি চুরি করেছ?
জি স্যার।
ঘটনা জানলাম–আমাদের এক অভিনেতার ব্যাগ রাখতে দেওয়া হয়েছিল তার কাছে। ব্যাগ, মানিব্যাগ, সিগারেটের প্যাকেট এবং আইফোন নামের দামি মোবাইল। সবই আছে, শুধু আইফোন নেই।
আমি ছালামকে বললাম, তুমি স্বীকার করেছ ফোন চুরি করেছ, ফেরত দিচ্ছ না কেন?
একটু অসুবিধা আছে।
বলো কী অসুবিধা?
সবার সামনে বলা যাবে না। তয় অপনারে বলব।
লোকজন সরালাম। ছালাম কষ্টে উঠে বসল। গলা নামিয়ে বলল, বিবি মোহতেরমা মোবাইলটা নিয়ে চলে গেছে। জিনিসটা তার খুবই পছন্দ হয়েছে। জ্বিনের বাদশাহ্র আদরের মেয়ে, সে একটা জিনিস চাইলে তো না করতে পারি না।
তাকে বলো ফেরত দিতে।
সে তো স্যার আশপাশে নাই। যখন আসবে তখন ফেরত দিতে বলব।
আমি বললাম, জ্বিন মেয়ে মোবাইল নিয়ে গেছে, এ ধরনের হাস্যকর কথা আর যে-ই বিশ্বাস করুক আমি করছি না। তুমি আইফোনটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছ, বের করে দাও।
স্যার, আমার কথা বিশ্বাস করেন–সে চেয়েছে বলে দিয়েছি। জ্বিনদের কাছে যন্ত্রপাতি নাই, যে কারণে যন্ত্রপাতির দিকে তাদের নজর। আমার একটা টর্চলাইট ছিল, নিয়া গেছে। ব্যাটারি শেষ হলে আমার কাছে ব্যাটারি নিতে আসে। ব্যাটারি কিনতে কিনতে আমি পথের ফকির হয়েছি।
এই উন্মাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালানো সময়ের অপচয়। আমি নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। প্রডাকশন ম্যানেজারকে বললাম, মারধর যেন করা না হয়।
প্রডাকশন ম্যানেজার বলল, এর বিষয়টা আপনি মাথা থেকে অফ করে দেন। আমি ব্যবস্থা নিতেছি। মারধর করা হবে না, সে আপসে জিনিস কোথায় লুকায়েছে বলে দিবে।
কী ব্যবস্থা নিচ্ছ।
একটা ঘরে তালাবন্ধ করে রাখব। খানা পানি দিব না। আগে মোবাইল বাইর করবে, তারপর রিলিজ।
শুটিং শেষ হলো সন্ধ্যায়। ছালামের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি হাতে-পায়ে দড়ি বেঁধে একটা ঘরে তাকে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। আমি বললাম, তাকে তো তালাবন্ধ করেই রেখেছ, আবার দড়ি দিয়ে বাঁধার দরকার কী?
প্রডাকশন ম্যানেজার কামরুল বলল, ভয় খাবে, এইজন্যে দড়ি দিয়ে বেঁধেছি।
ছালামকে দেখে মনে হলো না সে ‘ভয় খাচ্ছে’। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, জ্বিনের বাদশাহর কাছে খবর চলে গেছে, উনি আমারে রিলিজ করে দেবেন।
কামরুল বলল, জ্বিনের বাদশাহ তোর ‘…’ ঢুকায়ে দিব। (পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, শরীরের কোন পথে জ্বিনের বাদশাহ ঢোকানো হবে।)
আমি কামরুলকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললাম, ভয় দেখাতে চাচ্ছ দেখাও, কিন্তু সকালবেলা অবশ্যই ছেড়ে দিবে।
কামরুল বলল, সকাল হোক, তারপর দেখা যাবে।
সকালে নাশতা খেয়ে শুটিংস্পটে যাওয়ার জন্যে গাড়িতে উঠেছি। ড্রাইভার মেহেদি বলল, খবর পাইছেন স্যার? বদটা তালা ভাইঙা পালাইছে।
ছালামের কথা বলছ?
জি স্যার। সবাই বলাবলি করতেছে জ্বিন তালা ভাঙছে। আমরা জ্বিনের ঝামেলায় পড়লাম। কী ঘটে কে জানে!
আমি জবাব দিলাম না। মেহেদির নাপিতের মতো স্বভাব। অকারণে কথা বলে। তার প্রতিভা ইউনিটের তুচ্ছ কথাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে পত্রিকাওয়ালাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া। তাকে এই মুহূর্তে না আটকালে পত্রিকায় খবর আসবে ‘ঘেঁটুপুত্র কমলার ইউনিটে জ্বিনের হামলা’।
আমি বললাম, মেহেদি শোনো! জ্বিন তালা ভাঙে নি। ছালামের কোনো বন্ধুই গোপনে এই কাজ করেছে। এই বিষয়ে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না।
মেহেদি বলল, কামরুল ভাই বিরাট আতঙ্কের মধ্যে–জ্বিন তারে ধরবে। শুনেছি কামরুল ভাই ইউনিট ছাইড়া চলে যাবে।
চলে গেলে চলে যাবে। আমি বলেছি জ্বিনবিষয়ক আলোচনা বন্ধ। যে এই নিয়ে আলোচনা করবে তাকেও ইউনিট ছেড়ে চলে যেতে হবে।
আমার হার্ডলাইনে যাওয়ার কারণ আছে। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির শুটিং করছি নুহাশপল্লীতে। শুটিংয়ের এক পর্যায়ে জ্বিনের উপদ্রপের কথা ছড়িয়ে পড়ল। নানান। ধরনের কথাবার্তা আমার কানে আসতে লাগল।
তখন নুহাশপল্লী গজারি বনের জঙ্গল। আমি জঙ্গল পরিষ্কার করে পছন্দের গাছপালা লাগানো শুরু করি নি। ইলেকট্রিসিটি নেই, নিজস্ব জেনারেটরও নেই। শুটিংয়ের জন্যে ভাড়া করা জেনারেটরই ভরসা।
রাতে ঘরে ঘরে হারিকেন বা মোমবাতি জ্বালানো হয়। আঁধারি পরিবেশ। ভূত প্রেত-জ্বিন উঁকি মারার অবস্থা। হঠাৎ করেই জ্বিনের গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল।