সবাই একসঙ্গে লাইন ধরে খেতে বসেছি। চোখে পড়ল জ্বিনের বাদশাহর বন্ধু ছামাদ আয়োজন করে খাচ্ছে। আমি প্রডাকশন ম্যানেজারকে বললাম, ওই লোক ইউনিটের কেউ?
ম্যানেজার বলল, জি-না স্যার। সে বলেছে আপনি নাকি অর্ডার দিয়েছেন যতদিন শুটিং চলবে সে তিন বেলা খাবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
ম্যানেজার চিন্তিত গলায় বলল, আপনি কি এমন কথা বলেন নাই? কী সর্বনাশ!
আমি বললাম, সর্বনাশের কিছু নাই। খাক তিন বেলা। শুধু বলে দাও–আমাকে যেন বিরক্ত না করে, আমার ধারে কাছে যেন না আসে।
ম্যানেজার বলল, স্যার আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। আপনার দশ গজের ভেতর গেলে তার ঠ্যাং ভেঙে দিব।
সোনামুখি সুঁই (সবচেয়ে সূক্ষ্ম সুঁই) হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হওয়ার কথা শোনা যায়। ছামাদের ব্যাপারেও তা-ই দেখলাম। সে অল্প সময়ের ভেতরই প্রডাকশনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে গেল। সে ভিড় সামলাচ্ছে, শিল্পীদের মাথার উপর ছাতি ধরছে, খাবার পরিবেশন করছে। একদিন দেখলাম প্রডাকশন ম্যানেজারের গায়ে সাবান ডলে গোসল করিয়ে দিচ্ছে।
সিনেমার শুটিং-এ সিগারেটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কে ফ্রি সিগারেটের প্যাকেট পাবে কে পাবে না তা নির্ধারিত। এই নিয়ে হইচই ঝুট-ঝামেলা হয়। কেউ কেউ রেশনিং মানতে চায় না। ফ্রি সিগারেটের জন্যে দেনদরবার। একদিন দেখলাম এই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্ব ছামাদের হাতে চলে গেছে। সে মেকাপম্যানের সঙ্গে সিগারেট নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছে।
আমারে আপনে যদি চাইনিজ কুড়াল দিয়া কোপ্তদেন তারপরেও সিগারেট মিলবে না। ইউনিটের নিয়মে আমারে চলতে হবে টাকা দেন, আপনের সিগারেট নিয়ে আসব।
আমি ছামাদের উত্থান নিয়ে ঘামালাম না। ফিল্ম ইউনিটে উত্থান ও পতন স্বাভাবিক ঘটনা। ছামাদ যে জ্বিনের গল্প করে আমাকে বিরক্ত করছে না, এতেই আমি খুশি।
‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ ছবির আউটডোর শুটিং সন্ধ্যার পরপর শেষ হয়ে যেত। রাতের সব কাজ রাখা হয়েছিল সেটের জন্যে। দুর্গম হাওরে লাইট নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু দৈত্যাকৃতি জেনারেটর নিতে পারি নি। আমাদের সন্ধ্যার পর কিছুই করার থাকেনা। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দরজা বন্ধ করে ঘুমান। এই বিষয়টি শুধুমাত্র ফিল্মের শুটিংয়ের বেলায় দেখা যায়। মনে হয় ৩৫ মি.মি. ক্যামেরার সামনে অভিনয় করা স্লিপিং ট্যাবলেট হিসেবে কাজ করে।
ক্রু মেম্বার আর প্রডাকশনের ছেলেমেয়েরা অবসরে গানবাজনা করে। তাদের সঙ্গে সবসময় হারমোনিয়াম ও তবলা থাকে।
এক সন্ধ্যায় দেখি গানবাজনার আসরে আমাদের ছালাম বাবরি চুল দুলিয়ে গান করছে—কাজল ভোমরা রে কোনদিন আসিবে ফিরে কয়া যাও কয়া যাও। আব্বাসউদ্দীনের বিখ্যাত গান।
ছালাম সুর খানিকটা এদিক-ওদিক করেছে, কিন্তু গাইছে চমকার। তার গলা খানিকটা মেয়েলি হলেও সুর আছে। স্ট্যান্ডিং নোট কাঁপছে না। গানের মূল শক্তি আবেগ। সেই আবেগেরও কোনো ঘাটতি দেখলাম না, বরং খানিকটা বাড়াবাড়ি দেখলাম। আজকাল বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নানান ধরনের গানের প্রতিযোগিতা হয়–রাজমিস্ত্রিদের গান, রাজমিস্ত্রির জোগালিদের, ট্রাক ড্রাইভার, হেলপারদের গান, এক চোখ নষ্ট ভিক্ষুকদের গান। প্রতিযোগিতার অভাব নেই। ছালামের গান শুনে আমি নিশ্চিত যে, এই ধরনের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন বা রানারআপ হওয়ার যোগ্যতা রাখে। আমি ছালামকে ডেকে পাঠালাম। আমাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা হলো—
তোমার গানের গলা তো খুব সুন্দর!
জে স্যার। এই গান আমারে খাইছে। বিরাট বিপদে আছি।
কী রকম বিপদ?
লম্বা হিস্টোরি। স্যার বলব?
সারসংক্ষেপ করে বলো।
একদিন নিশিরাইতে মনটা উদাস হয়েছিল। গানে টান দিলাম। আব্দুল আলিম সাহেবের গান–’হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ পাখিটি ছাড়িল কে?’ এই সময় আমার মাথার উপরে দিয়া উইড়া যাইতেছিল জ্বিনের বাদশাহর পঞ্চম মেয়ে। নাম বিবি মোহতেরমা। সে আসমান থাইকা নামল। অপূর্ব রূপবতী মেয়েছেলের বেশ ধরল। লইজ্জার বিষয় কি জানেন স্যার, মেয়েছেলের বেশ ঠিকই ধরেছে, কিন্তু শইল্যে কাপড় নাই। আমি দুই হাতে চোখ ঢাইকা বললাম, কন্যা, তোমার পরিচয়?
সে বলল, আমি জিনের বাদশাহর পঞ্চম কন্যা। আমার নাম বিবি মোহতেরমা। আপনের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি। আপনে আমার সঙ্গে কোহকাফ নগরে চলেন। সেখানে আমি পিতার অনুমতি নিয়া আপনারে শাদি করব। তখন আমি…
গল্পের এই পর্যায়ে ছালামকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি এখন যাও।
ছালাম আহত গলায় বলল, আর শুনবেন না?
আমি বললাম, না।
বিরাট ইন্টারেস্টের জায়গাটা এখনো বলি নাই।
বলতে হবে না, তুমি বিদায় হও।
ছালাম বিমর্ষমুখে চলে গেল। আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে ভাবছি, এই ধরনের গল্প সে কেন বানাচ্ছে?
দু’টা কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ, অন্যের কাছে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করা। জ্বিনের বাদশাহর সঙ্গে যার মেলামেশা সে গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই।
দ্বিতীয় কারণটা মানসিক। এক ধরনের ডিলিউশনের শিকার হয়ে কিছু মানুষ এই ধরনের কাণ্ড করে। সমাজে ডিলিউশনগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা কম না। ‘জনগণ তার জন্যে পাগল’–এই ডিলিউশনে অনেক রাজনীতিবিদ ভোগেন।
আমার এক বন্ধু ভাবেন, যে-কোনো মেয়ের চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সেই মেয়ে আধাপাগল হয়ে ছুটে আসবে। এমনই তার চোখের সম্মোহনী শক্তি। প্রবল সম্মোহনী শক্তির কারণে ভীত হয়েই তিনি সচরাচর কোনো তরুণীর চোখের দিকে তাকান না। চোখে চোখ পড়লে চট করে চোখ নামিয়ে নেন। এটাও ডিলিউশন।