- বইয়ের নামঃ হিজিবিজি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ ছোট গল্প, গল্পের বই, আত্মজীবনী, জীবনী
অধ্যাপক ইউনূস
একটি দৈনিক পত্রিকা অধ্যাপক ইউনূসকে নিয়ে প্রথম পাতায় কার্টুন ছেপেছে। সেখানে তিনি হাসিমুখে রোগাভোগা একজন মানুষের পা চেপে শূন্যে ঝুলিয়েছেন। মানুষটার মুখ থেকে ডলার পড়ছে। অধ্যাপক ইউনূস বড় একটা পাত্রে ডলার সংগ্রহ করছেন। কার্টুন দেখে কেউ কেউ হয়তো আনন্দ পেয়েছেন। আমি হয়েছি ব্যথিত ও বিস্মিত। পৃথিবী-মান্য একজন মানুষকে এভাবে অপমান করা যায় না। ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনি, মানীকে মান্য করিবে।
বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত দুটি পঙক্তিও আছে—
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়
তদ্যপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
অধ্যাপক ইউনূসকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তাঁর সঙ্গে আমার কখনো দেখাও হয় নি। এর প্রধান কারণ, অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের কাছ থেকে আমি নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পছন্দ করি। অনেক বছর আগে যখন অধ্যাপক ইউনূস নক্ষত্র হয়ে ওঠেন নি, আমি তাঁর কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে একটি বই উৎসর্গ করেছিলাম। সেই বইও আমি নিজের হাতে তাকে দিই নি। যত দূর মনে পড়ে, ইউনূস সাহেবের ছোটভাই সাংবাদিক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের হাত দিয়ে পাঠিয়েছি। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর সমাজের অতি গুরুত্বপূর্ণ কেউ না বলে তাঁর সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ সখ্য আছে।
অধ্যাপক ইউনূস যখন নোবেল পুরস্কার পান, তখন আমি নাটকের একটি ছোট্ট দল নিয়ে কাঠমাণ্ডুর হোটেল এভারেস্টে থাকি। হোটেলের লবিতে বসে চা খাচ্ছি, হঠাৎ আমার ইউনিটের একজন চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এল। সে বলছে, স্যার, আমরা নোবল পুরস্কার পেয়েছি। স্যার, আমরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছি।
সে বলে নি, অধ্যাপক ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সে বলেছে, আমরা পেয়েছি। অধ্যাপক ইউনূসের এই অর্জন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্জন।
আমার মনে আছে, এই আনন্দ-সংবাদ শোনার পর আমি শুটিং বাতিল করে উৎসবের আয়োজন করি। সেই উৎসবের শিখা আমি বুকের ভেতর এখনো জ্বালিয়ে রেখেছি।
দেশের বাইরে যখন সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে যাই, তখন আগের মতো হীনম্মন্যতায় ভুগি না। কারণ, এই সবুজ পাসপোর্ট অধ্যাপক ইউনূসও ব্যবহার করেন, আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়েরা ব্যবহার করেন।
আমার ছোট ছেলে নিষাদ সাহস বলতে পারে না। হ উচ্চারণে তার সমস্যা হয়। সে বলে সাগস। আমিও তার মতো করে বলছি, অধ্যাপক ইউনূসকে ছোট করছে, কার এত বড় সাগস!
মানী লোকদের অসম্মান করে আমরা কী আনন্দ পাই? ব্যাপারটার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আমরা যারা সাধারণ, তারা বলতে পারি, এই দেখো, তুমি আমাদের মতোই সাধারণ।
একটি পত্রিকায় পড়লাম, গান্ধীজীকে নিয়ে বই লেখা হয়েছে। সেই বইয়ে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে, গান্ধীজি ছিলেন সমকামী। হায় রে কপাল!
অধ্যাপক ইউনূসকে গান্ধীজির মতো গভীর গর্তে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা হলেও আমি বিস্মিত হব না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়ই তাঁর পেছনে থাকব এবং আশা করব, তার মাথার ওপরের ঘন কালো মেঘ সরে সূর্যকিরণ ঝলমল করে উঠবে। আশা করা ছাড়া একজন লেখক আর কী-ইবা করতে পারেন।
দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতালি
ঈদ ভয়ংকর!
ভাবতে অবাক লাগে, একসময় আমার ঈদও আনন্দময় ছিল। তখন আমাকে ঈদসংখ্যায় উপন্যাস লিখতে হতো না। কারণ ‘ঈদসংখ্যা’ নামক কোনো বস্তু ছিল না। বিটিভিতে ঈদের হাসির নাটক লিখতে হতো না, এই দায়িত্ব জনাব আমজাদ হোসেন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। বিটিভির কর্মকর্তা মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের কাছে শুনেছি, আমজাদ হোসেনের কাছ থেকে ঈদের নাটক আদায় করা কঠিন ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে কাগজ-কলম দিয়ে বিটিভির একটা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হতো। নাটক শেষ হলে মুক্তি, তার আগে না।
মানুষের কোনো সুখই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমারও ঈদসুখ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের ফাঁদে পড়ে এক ঈদে হাসির নাটক লিখতে রাজি হলাম। সবাই খাল কেটে কুমির আনে, আমি খাল কেটে অক্টোপাস নিয়ে এলাম। এই অক্টোপাস আমাকে আট পায়ে আঁকড়ে ধরল। বাংলাদেশের মানুষদের ঈদের দিনে হাসানো আমার পবিত্র এবং মহান দায়িত্ব হয়ে গেল।
যে-কোনো দায়িত্বের সঙ্গে টেনশন থাকে, সেই দায়িত্ব যদি মহান হয় টেনশন মহা হয়ে যায়। আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করি রোজার শুরুতেই। স্ক্রিপ্ট লিখি, স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয় না। আবার লিখি, আবার লিখি।
বিটিভির রিহার্সেল রুমে রিহার্সেল হয়। প্রতিবারই আমি উপস্থিত থাকি। রিহার্সেল শুনে নাটক কাটাকুটি করি। প্রযোজক বিরক্ত হয়ে বলেন, এত কাটাকুটি করলে কীভাবে হবে? প্রতিদিন নতুন সংলাপ দিলে আর্টিস্ট কীভাবে মুখস্থ করবে?
বিখ্যাত সব আর্টিস্ট, প্রায়ই তাদের অভিনয়ের প্যাটার্ন আমার পছন্দ হতো না। মুখ ফুটে বলতে পারতাম না। যেহেতু হাসির নাটক, সব অভিনেতা-অভিনেত্রীই ভাবতেন দর্শক হাসানোর দায়িত্ব তাদের। অভিনয়ে স্থূলভাব চলে আসত। স্বাভাবিক সংলাপ তাদের অভিনয়ের গুণে অস্বাভাবিক শোনাত।
দৃশ্যগ্ৰহণও আমার মনের মতো হতো না। বড় অভিনেতাদের মুখের ওপর সবসময় ক্যামেরা ব্রা থাকত। ছোট অভিনেতারা বলতে গেলে ক্যামেরার আড়ালেই থাকতেন।