মনে থাকবে মা।
কোথায় বসবে বলে ঠিক করেছ?
তার বাঁ হাতে।
ভালো, খুব ভালো চিন্তা। শীলার মার ডান হাতে বই ধরা আছে। এই হাতে সে তোমাকে মারতে পারবে না। বাঁ হাত দিয়ে তো আর বাঁ হাতের মশা মারতে পারবে না। আমার ধারণা, কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই তুমি রক্ত খেয়ে চলে আসতে পারবে। যাও মা…
বড় মেয়ে পিঁ উড়ে গেল এবং রক্ত খেয়ে চলে এলো। শীলার মা কিছু বুঝতেও পারলেন না। একসময় শুধু বিরক্ত হয়ে হাত ঝাঁকালেন।
মা-মশা বললেন, আমার বুদ্ধিমতী বড় মেয়ে কী সুন্দর রক্ত খেয়ে চলে এসেছে! কিছু বুঝতেও পারেনি। এবার মেজ মেয়ের পালা…
মা-মশা কথা শেষ করবার আগেই পিঁপিঁ উড়ে গেল। তার আর তর সইছিল। সে শীলার মাকে দুবার চক্কর দিয়ে বসল তাঁর ঘাড়ে। এবার শীলার মা টের পেলেন। মশা মারার জন্যে বাঁ হাত উঁচু করলেন— মশা এমন জায়গায় বসেছে যে বাঁ হাত সেখানে পৌঁছে না। কাজেই মেজ মেয়ে পিঁপিঁও নির্বিঘ্নে রক্ত খেয়ে চলে এলো।
মা-মশা বললেন, তোমার কাজেও আমি খুশি, তবে তুমি দুটা চক্কর দিলে কেন? এটা উচিত হয়নি। শুধু গায়ে বসলেই যে মানুষ মশা মারে তা না— আশপাশে উড়তে দেখলেও মেরে ফেলে। তুমি বাহাদুরি করতে গিয়েছ। বাহাদুরি করাও নিষেধ। ভবিষ্যতে আরো সাবধান হবে। এবার সবচেয়ে ছোটজনের পালা…
বলতে না বলতেই পিঁপিঁপিঁ উড়তে শুরু করল। মা-মশা চিৎকার করে ডাকলেন, ফিরে এসো, ফিরে এসো।
পিঁপিঁপিঁ ফিরে এলো। মা-মশা বললেন, তুমিও কি ঐ শীলার মাকে কামড়াতে যাচ্ছিলে?
হ্যাঁ।
এত বড় বোকামি কি করতে আছে? এর আগে দুজন তার রক্ত খেয়ে গেছে। এখন সে অনেক সাবধানী। তার কাছে যাওয়াই ঠিক হবে না।
তাহলে কি শীলার বাবার রক্ত খাব মা?
হ্যাঁ, তা খাওয়া যেতে পারে। উনি গভীর মনোযোগে লেখালেখি করছেন। তার গা থেকে এক চুমুক রক্ত খেলে উনি বুঝতেও পারবেন না।
উনি কী লিখছেন মা?
মনে হয় গল্প লিখছেন।
সুন্দর গল্প?
সুন্দর গল্প না পচা গল্প তা তো জানি না–এখন মা, তুমি মন দিয়ে শোনো আমি কী বলছি–তুমি উনার হাতে বসবে। বসেই রোমকূপ খুঁজে বের করবে। যেখানে-সেখানে সুচ ফুটিয়ে দেবে না। সুচ ভেঙে যেতে পারে। সুচ ভাঙলে তীব্র ব্যথা হয়। মনে থাকবে?
হ্যাঁ মা, মনে থাকবে।
মানুষের শরীরে দুধরনের রক্ত আছে— শিরার রক্ত। এই রক্ত কালো, স্বাদ নেই। আর হলো ধমনির পরিষ্কার ঝকঝকে রক্ত। খুব স্বাদ। ধমনির রক্ত খাবে। মনে থাকবে?
হ্যাঁ থাকবে।
লোভীর মত রক্ত খাবে না। মনে রাখবে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
মা, আমার মনে থাকবে।
তুমি তো একটু বোকা— এইজন্যেই তোমাকে নিয়ে আমার ভয়।
মা, একটুও ভয় পেও না। দেখ না আমি যাব আর চলে আসব। মা যাই?
মা-মশা চিন্তিত মুখে বললেন, আচ্ছা যাও।
পিঁপিঁপিঁ শীলার বাবার হাতে বসেছে। রোমকূপ খুঁজে বের করে তার শূড় নামিয়ে দিয়েছে। শূড় বেয়ে রক্ত উঠে আসছে। পিঁপিঁপিঁর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল— কী মিষ্টি রক্ত! কী মিষ্টি! মনে হচ্ছে, আহ, সারাজীবন ধরে যদি এই রক্ত খাওয়া যেত! সে খেয়েই যাচ্ছে, খেয়েই যাচ্ছে, তার পেট বেলুনের মতো ফুলছে… তার কোনোই খেয়াল নেই।
মা-মশা চিৎকার করে কাঁদছেন— বোকা মেয়ে, তুই কী সর্বনাশ করছিস! তুই উঠে আয়। এখনো সময় আছে। এখানে হয়তো কষ্ট করে উড়তে পারবি…
পিঁপিঁপিঁ মার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। সে রক্ত খেয়েই যাচ্ছে। পিঁপিঁপিঁর দুই বোন এখন কাঁদছে, আর ভাইও কাঁদছে।
মা-মশা ফোঁপাতে বললেন, ও রে বোকা মেয়ে, শীলার বাবা তো এক্ষুনি তোকে দেখবে। পিষে মেরে ফেলবে–তুই উড়ে পালিয়েও যেতে পারবি না। তোকে এত করে শিখিয়ে দিলাম, তারপরেও তুই এত বড় বোকামি কী করে করলি…!
মা-মশার কথা শেষ হবার আগেই শীলার বাবা মশাটাকে দেখলেন–রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। নড়াচড়া করতে পারছে না। ঝিম মেরে হাতের ওপর বসে আছে। তিনি মশাটাকে তার লেখার কাগজের ওপর ঝেড়ে ফেললেন। মশাটা অনেক কষ্টে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক বার উড়ার চেষ্টা করল। পারল না। শীলার বাবা বললেন, আমার মামণিরা কোথায়? মজা দেখে যাও।
মজা দেখার জন্যে তিন মেয়েই ছুটে এলো। দেখ, এই দেখ। মশাটাকে দেখ, রক্ত খেয়ে কেমন হয়েছে। উড়তে পারছে না।
শীলা বলল, এর মধ্যে মজার কী আছে বাবা? তুমি কী যে পাগলের মতো বলো! মশাটাকে মেরে ফেল।
মেরে ফেলব?
অবশ্যই মেরে ফেলবে। সে তোমার রক্ত খেয়েছে, তুমি তাকে ছেড়ে দেবে কেন? তোমার হয়ে আমি মেরে দেই?
না না, মারিস না। মারিস না— থাক না।
মারব না কেন?
তুচ্ছ একটা প্রাণী শুধু শুধু মেরে কী হবে?
তোমার রক্ত খেয়েছে তো!
বেচারার খাবারই হচ্ছে রক্ত। না খেয়ে করবে কী? আমরা হাঁস-মুরগি এইসব মেরে মেরে খাচ্ছি না? আমাদের যদি কোনো দোষ না হয় ওদেরও দোষ হবে না।
পিঁপিঁপিঁ খানিকটা শক্তি ফিরে পেয়েছে অনেকবারের চেষ্টায় সে একটু উড়তে পারল। খানিকটা উড়ল— ওমনি তাকে সাহায্যের জন্যে তার মা, ভাই ও দুই বোন ছুটে এল। তারা তাকে ধরে ধরে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
পিঁপিঁপিঁ বলল, মা, আমারা যে চলে যাচ্ছি ঐ ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে গেলাম না তো। উনি ইচ্ছা করলে আমাকে মেরেও ফেলতে পারতেন কিন্তু মারেননি।
উনাকে ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই মা। উনি আমাদের ধন্যবাদ বুঝবেন না। তা ছাড়া যারা বড় তারা কখনো ধন্যবাদ পাবার আশায় কিছু করে না।