ছেলে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। বানিয়ে বানিয়ে কথা যে বলে যাচ্ছে তার জন্যে তার মধ্যে কোনো রকম বিকার দেখা যাচ্ছে না। মোবারক হোসেনের ইচ্ছা করছে মিথ্যা কথা বলার জন্যে ঠাস করে এর গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে।
তোমার পায়ের জুতা তো মনে হচ্ছে বাটা কোম্পানির। পরীর দেশেও তাহলে বাটা কোম্পানি দোকান খুলেছে?
জুতা আমার মা এখান থেকে কিনে দিয়েছে। পরীর দেশের ছেলেমেয়েরা জুতা পরে না। তারা তো আকাশে আকাশেই ওড়ে, তাদের জুতা পরতে হয় না।
মোবারক হোসেন সাহেব ছেলের বুদ্ধি দেখে অবাক হলেন। সুন্দর করে নিজেকে কাটান দিয়ে যাচ্ছে। এই ছেলে রাজনৈতিক দলের নেতা হবে না, নেতাদের এত বুদ্ধি থাকে না।
তুমি তাহলে পরীদের ছেলে, এখানে বেড়াতে এসেছ?
মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে এসেছি। ওরা কত সুন্দর সুন্দর খেলা জানে।
তুমি তাহলে প্রথম পরীর বাচ্চা যে মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে এসেছে।
না তো, আমরা সব সময় আসি।
সব সময় আস?
জি। ওদের সঙ্গে খেলি তারপর চলে যাই। ওরা বুঝতে পারে না।
তাই নাকি?
জি। যখনই দেখবেন একদল ছেলেমেয়ে খেলছে তখনই জানবেন ওদের মধ্যে অতি অবশ্যই দু-একজন পরীর ছেলেমেয়ে আছে।
পাখা ছাড়া আস কী করে?
আমাদের উড়তে পাখা লাগে না। পাখাটা হচ্ছে আমাদের এক ধরনের পোশাক। জন্মদিনে আমরা নতুন পাখা পাই। আবার দুষ্টুমি করলে মারা আমাদের পাখা নিয়ে নেন। আমার কটা পাখা আছে জানেন? সব মিলিয়ে সাতটা—সেভেন।
তুমি ইংরেজিও জানো? পরীর দেশে ইংরেজি চালু আছে?
আপনি আমার সঙ্গে এমন রেগে রেগে কথা বলছেন কেন?
মোবারক হোসেন সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, দেখ খোকা–কী যেন নাম তোমার?
শীশী।
দেখ শীশী। তোমার কথা শুনে রাগে আমার শরীর রি রি করছে। এই বয়সে তুমি যে মিথ্যা শিখেছ…
আপনার ধারণা আমি মিথ্যা কথা বলছি?
অবশ্যই মিথ্যা কথা বলছ। এই মিথ্যা বলার জন্যে তোমাকে কানে ধরে উঠবস করানো দরকার।
বাহ আপনাদের মিথ্যা বলার শাস্তিটা তো খুব মজার?
কানে ধরে উঠবস তোমার কাছে মজা মনে হলো?
অবশ্যই মজার। আমরা মিথ্যা বললে কী শাস্তি হয় জানেন? আমরা মিথ্যা বললে আমাদের পাখায় কালো দাগ দিয়ে দেয়া হয়। যে যত মিথ্যা বলে তার পাখায় ততই কালো দাগ পড়ে।
মোবারক হোসেন এই ছেলের গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতায় আরো মুগ্ধ হলেন। ছেলেটা পড়াশোনায় কেমন কে জানে। ভালো হওয়া তো উচিত।
শোন খোকা— তোমার রোল নাম্বার কত? রোল নাম্বার মানে কী?
ক্লাসে যে পড় তোমার রোল কত?
আমি ক্লাসে যাই না তো। পরীর বাচ্চাদের স্কুলে যেতে হয় না। আমাদের যা শেখার আকাশে উড়তে উড়তে বাবামার কাছ থেকে শিখি…।
আমি অনেক মিথ্যুক দেখেছি, তোমার মতো দেখিনি। এই দেশের যেকোনো রাজনৈতিক নেতাকে তুমি মিথ্যা বলায় হারিয়ে দিতে পারবে।
আমি মিথ্যা বলছি না তো। এই দেখুন আমি উড়ছি…।
বলতে বলতে ছেলে তিন-চার ফুট উপর উঠে গেল। শূন্যে কয়েক বার ঘুরপাক খেল। আবার নেমে এলো নিজের জায়গায়। হাসিমুখে বলল, দেখেছেন?
মোবারক হোসেন কিছু বললেন না। তিনি দ্রুত মনে করতে চেষ্টা করলেন, সকালে কী নাশতা খেয়েছেন। অনেক সময় বদহজম হলে মানুষের দৃষ্টি বিভ্রম হয়।
আমার কথা কি আপনার বিশ্বাস হচ্ছে?
মোবারক হোসেন সাহেব এবারও জবাব দিলেন না। তার কপাল ঘামছে। পানির পিপাসা পেয়ে গেছে। শীশী বলল, আপনার সঙ্গে তো খেলা হলো না, আরেক দিন এসে খেলব। আজ যাই।
মোবারক হোসেন সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, যাবে কীভাবে? উড়ে চলে যাবে?
হুঁ।
তিনি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। তাঁর হতভম্ব চোখের সামনে দিয়ে ছেলে উড়ে চলে গেল।
বাসায় ফিরতেই তাঁর দেখা হলো বড় মেয়ের সঙ্গে। তিনি তাকে পুরো ঘটনা বললেন। বড় মেয়ে বলল, বাবা, তুমি বিছানায় শুয়ে থাক। আমি আসছি। তোমার মাথায় পানি ঢালব।
কেন?
রৌদে ঘুরে ঘুরে তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে, এইজন্যে।
তুই আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?
ওমা! কে বলল বিশ্বাস করছি না? করছি তো।
রাতের মধ্যে সবাই জেনে গেল মোবারক হোসেন সাহেবের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনে বাড়ি ভরে গেল। ডাক্তার এলেন, সাইকিয়াট্রিস্ট এলেন। হুলস্থুল ব্যাপার।
মোবারক হোসেন সাহেবের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসায় তেমন উন্নতি হচ্ছে। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন ঐদিন এক পরীর ছেলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। দুপুর হলেই তিনি পার্কে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠেন। মাঝে মাঝে চিৎকার-চেঁচামেচিও করেন। তাঁকে যেতে দেয়া হয় না। ছোট্ট একটা ঘরে তাঁকে সব সময়ই তালাবদ্ধ করে রাখা হয়।