আমার চিৎকার হইচই শুনে টুত নিজেই ভয় পেয়ে গেল। সে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, মামা, আপনি কি সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছেন?
আমি বললাম, কথা বলে সময় নষ্ট করিস না–তুই এখন টেবিল থেকে জিনিসপত্র মাটিতে ফেলতে থাক। কাচের জিনিস ফেলবি না। ভাঙা কাচে পা কাটতে পারে। বই-খাতা শব্দ করে মাটিতে ফেল।
ধুম ধুম শব্দে বই-খাতা মাটিতে পড়তে লাগল। আমি তখন চড়কির মতো সারা ঘরে ঘুর পাক খাচ্ছি আর বলছি–এসব কী হচ্ছে! এসব কী হচ্ছে? ভূত আমাকে মেরে ফেলল! আমাকে বাঁচাও! কে কোথায় আছে আমাকে বাঁচাও!
সুইস টিপে বাতি জ্বালালাম। মিরখাই সঙ্গে সঙ্গে বাতি নিভিয়ে ফেলল। আমি চিৎকার করে বললাম, এসব কী হচ্ছে! বাতি নিভে যাচ্ছে কেন? বলে আবার বাতি জ্বালালাম। মিরখাই আবার বাতি নিভিয়ে ফেলল। আমি একটা বিকট চিৎকার করে গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে মেঝেতে পড়ে গেলাম।
মিরখাইয়ের স্কুলের হেড মাস্টার সাহেব বললেন, থাক থাক, আর লাগবে, আর লাগবে না। বাদ দাও, শেষে মরেটরে যাবে। দেখে মনে হচ্ছে হার্ট এটাক হয়ে গেছে। মিরখাই, তুমি পাস করেছ। শুধু পাস না, মুন-মার্ক পেয়ে পাস করেছ। ভেরি গুড। ভেরি গুড। চল যাওয়া যাক।
মিরখাই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, মামা যাই।
আমি বললাম, আচ্ছা যা, আর শোন, ভালোমতো পড়াশোনা করিস।
নীতু বলল, মামা, গল্প কি শেষ হয়ে গেল?
হ্যাঁ।
এটি কি সত্যি গল্প মামা?
অবশ্যই সত্য গল্প।
মিরখাইয়ের সঙ্গে কি এখনো দেখা হয়?
হয়। আসে মাঝেমধ্যে।
এখন মিরখাই কী করে?
ও এখন ভূত এবং টুত সমাজে বিরাট ব্যক্তিত্ব। টুত ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারি করে। এসোসিয়েট প্রফেসর। চারটা বই লিখেছে। বিরাট নাম করেছে বই লিখে।
কী বই লিখেছে?
মানুষকে কী করে ভয় দেখাতে হয় সেই বিষয়ে বই। মানুষকে ভয় দেখানোতে সে খুব নাম করেছে তো, সে জন্যে ঐ বিষয়ে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে, গবেষণা করেছে। পিএইচ.ডি ডিগ্রি নিয়েছে। টুত সমাজে মানুষকে ভয় দেখানোর কৌশল এখন তার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। সে খুবই জ্ঞানী ব্যক্তি।
সত্যি, মামা?
হ্যাঁ সত্যি। তার একটা বই আছে, টুত ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য–মানুষকে ভয় দেখানোর সহজ, জটিল ও মিশ্র পদ্ধতি, আরেকটা বই আছে যেটা নানা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। খুবই কঠিন বই, নাম হল–ভয়ের রূপরেখা।
উনি বাচ্চাদের জন্যে বই লিখেননি?
নিচু ক্লাসের ছাত্রদের জন্যেও তার বই আছে— খেলতে খেলতে ভয় দেখানো। মিরখাইয়ের সঙ্গে আলাপ করতে চাস? চাইলে একদিন আসতে বলি।
না মামা, আসতে বলার দরকার নেই।
তোর অটোগ্রাফ লাগবে? অটোগ্রাফ লাগলে অটোগ্রাফের খাতাটা দিয়ে দিস। অটোগ্রাফ এনে দেব।
জাহেদুর রহমান সাহেব নীতুর অটোগ্রাফের খাতায় মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ এনে দিয়েছেন। নীতু খাতা দেখে বলল, কোনো তো লেখা দেখছি না মামা।
জাহেদ সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, দেখবি কী করে? মিরখাই নিজে যেমন অদৃশ্য তার হাতের লেখাও অদৃশ্য।
এখানে কী লেখা আছে মামা?।
এখানে লেখা— স্নেহের নীতুকে। নীতু, ভয়কে জয় কর, মিরখাই। খাতাটা যত্ন করে রাখিস মা। টুতের অটোগ্রাফ পাওয়া সহজ ব্যাপার না।
নীতু তার অটোগ্রাফের খাতা খুব যত্ন করে তুলে রেখেছে। কেউ এলেই সে মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ খুব আগ্রহ করে দেখায়।
মোবারক হোসেনের মহাবিপদ
ছেলেটা বড় যন্ত্রণা করছে।
মোবারক হোসেন হুংকার দিলেন, এ্যাঁও।
এটা তাঁর বিশেষ ধরনের হুংকার। বাচ্চারা খুব ভয় পায়। শব্দটা বেড়ালের ডাকের কাছাকাছি, আবার ঠিক বেড়ালের ডাকও নয়, বাচ্চাদের ভয় পাবারই কথা।
তবে এই বাচ্চা ভয় পাচ্ছে না। আগের মতোই লাফালাফি করছে। মনে হচ্ছে তার ধমক শুনতে পায়নি। এ যুগের টিভি-ভিসিআর দেখা বাচ্চা, এরা সহজে ভয় পায় না।
গত মাসে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলেন। সময় কাটে না। এইজন্যেই যাওয়া, অন্য কিছু না। সত্তর বছরের বুড়োরা চিড়িয়াখানায় যায় না। খানিকক্ষণ বাঁদরের লাফঝাঁপ দেখে গেলেন বাঘের খাঁচার সামনে। আলিশান এক রয়েল বেঙ্গল। দেখে যে-কোনো মানুষের পিলে চমকে যাবার কথা। আশ্চর্য কাণ্ড! ছোট বাচ্চাকাচ্চারা কেউ ভয় পাচ্ছে না। একটা আবার কান্না শুরু করে দিয়েছে, সে বাঘের লেজ ধরতে চায়। বাবা- মা শত চেষ্টাতেও কান্না সামলাতে পারছেন না। মিষ্টি মিষ্টি করে মা বুঝানোর চেষ্টা করছে।
বাঘমামার লেজে হাত দিতে নেই। বাঘমামা রাগ করবে।
হাত দেব। হাত দেব। উঁ উঁ।
মোবারক হোসেন সাহেব সত্তর বছর বয়সে একটা জিনিস বুঝে গেছেন— এ যুগের ছেলেমেয়ে বড়ই ত্যাঁদর। এরা ভূতের গল্প শুনলে হাসে। রাক্ষসের গল্প শুনলে হাসে। এরা ধমকেও পোষ মানে না। আদরেও পোষ মানে না।
এই যে ছেলেটা তখন থেকে তাঁকে বিরক্ত করছে একে ধমক-ধামক দিয়ে কিছু হবে বলে মনে হয় না। মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে লাফ-ঝাঁপ দিয়েই যাচ্ছে। তিনি পার্কে এসেছেন বিশ্রামের জন্যে। শীতকালের রোদে পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকতে বড় ভালো লাগে। শীতকালে পার্কে বিশ্রামের নিয়ম হলো, শরীরটা থাকবে রোদে, মাথাটা থাকবে ছায়ায়। ঘুম ঘুম তন্দ্রা অবস্থায় কিছুক্ষণ গা এলিয়ে পড়ে থাকা।
তাঁর যে বাড়িতে জায়গা নেই তা না। নিজের দোতলা বাড়ি আছে মগবাজারে কিন্তু সেই বাড়ি হলো মাছের বাজার। দিনরাত ক্যাঁও ক্যাঁও ঘ্যাঁও ঘ্যাঁও হচ্ছেই। একদল শুনছে ওয়ার্লড মিউজিক। একদল দেখছে জিটিভি। এখন আবার বড় মেয়ে এসেছে তার আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে। দুটা ছেলেমেয়ে কিন্তু অসীম তাদের ক্ষমতা। দেড়শ ছেলেমেয়ে যতটা হইচই করতে পারে, এই দুজন মাশাআল্লাহ তার চেয়ে বেশি পারে। আর কী তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা! এক ভাই খাটের ওপর চেয়ার বসিয়ে তার ওপর মোড়া দিয়ে অনেক কষ্টে তার ওপর উঠে সিলিং ফ্যান ধরে ঝুলে পড়েছে, অন্য ভাই ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়েছে। এটা নাকি একটা খেলা। এই খেলার নাম, হেলিকপ্টার খেলা। যে বাড়িতে হেলিকপ্টার খেলা হচ্ছে সবচেয়ে কম বিপজ্জনক খেলা সে বাড়িতে দুপুরে বিশ্রাম নেয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তিনি কদিন ধরেই পার্কের বেঞ্চিতে এসে কাত হচ্ছেন। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এখানেও বিশ্রাম নেয়া যাবে না। এই পিচকা বড়ই যন্ত্রণা করছে!