তোমার ধমকের জোর খুব বেশি ছিল?
ভয়ঙ্কর ছিল। নিজের ধমকে নিজেই ভয় পেয়ে গেলাম। আর তখন শুনলাম মিনমিন করে কে যেন কথা বলল। কথা পরিষ্কার না, একটু জড়ানো। আমি বললাম, কথা কে বলছে?
আমি?
আমিটা কে? নাম কী?
আমার নাম মিরখাই।
তুই কে? ভূত নাকি?
জি না, আমি ভূত না, আমি টুত।
তুই আমার আঙুল ধরে আছিস কেন? ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিস?
হুঁ।
কেন?
ভূতের বাচ্চা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি বললাম, ব্যাপারটা কী? কাঁদছিস কেন? কোনো জবাব নেই–কান্না আরো বেড়ে গেল। আমার মায়াই লাগল; ব্যাপার কিছু বুঝছি না। কেন কাঁদছে জানা দরকার।
মামা, ওর কি পেটে ব্যথা?
তখনও জানি নাআ–তবে পেটে ব্যথা হতে পারে। পেটে ব্যথার কারণে কাঁদাটা অস্বাভাবিক না। আবার অন্য কারণও থাকতে পারে হয়তো পথ হারিয়ে ফেলেছে। খুব অল্প বয়স যাদের ওরা মাঝে মাঝে পথ হারিয়ে ফেলে— তখন কান্নাকাটি শুরু করে আমি বললাম, কী রে তুই পথ হারিয়ে ফেলেছিস?
না।
পেটে ব্যথা?
না।
কেউ মারধর করেছে?
না।
তাহলে ব্যাপারটা কী খুলে বল। কান্না বন্ধ করে বল হয়েছে কী।
টুতের বাচ্চা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, পরীক্ষায় ফেল করেছি।
বলিস কি?
নীতু বলল, মামা, টুতের বাচ্চাদের স্কুল আছে?
অবশ্যই আছে। প্রাইমারি এডুকেশন এদের জন্যে কম্পলসারি।
ওদের কী কী পড়ানো হয়?
সবই পড়ানো হয়— অঙ্ক, ভূগোল, ইতিহাস, ধর্ম…
ও কীসে ফেল করেছে?
ও ফেল করেছে ভয় দেখানো বিষয়ে।
সেটা কী?
সব ভূত-টুতের বাচ্চাদের ১০০ নম্বরের একটা পরীক্ষা দিতে হয়— ভয় দেখানো পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় এরা মানুষকে ভয় দেখায়। যে ভয় দেখাতে পারে না সে ফেল করে। ভয় দেখানো পরীক্ষায় ফেল মানে ভয়াবহ ব্যাপার। এই বিষয়ের ফেলের অর্থ হলো সব বিষয়ে ফেল। মিরখাই কাউকে ভয় দেখাতে পারে না। পরপর দুবার ফেল করেছে।
নীতু বলল, আহা বেচারা!
আজ তার পরীক্ষা। সে আমাকে ভয় দেখাবে। আমি যদি ভয় পাই তাহলে পাস করবে। ভয় না পেলে আবার ফেল। আজ ফেল করলে পরপর তিনবার ফেল হবে— তাকে স্কুল থেকে বের করে দেবে।
কী ভয়ঙ্কর!
ভয়ঙ্কর মানে মহাভয়ঙ্কর!
তুমি ভয় পাচ্ছ না কেন মামা? একটু ভয় পেলে কী হয়?
আমি নিজেও তাই ঠিক করলাম— ভাবলাম, এমন ভয় পাব যে টুত সমাজে হইচই পড়ে যাবে। মিরখাই শুধু যে পরীক্ষায় পাস করবে তাই না, মুন-মার্ক পেয়ে পাশ করবে
মুন-মার্কটা কী?
একশতে আশি নম্বরের ওপর পেলে হয় স্টার মার্ক। একশতে ৯০ নম্বরের ওপর পেলে হয় মুন-মার্ক। যাই হোক, আমি বললাম, মিরখাই, তোর পরীক্ষা শুরু হবে কখন?
মিরখাই বলল, রাত বারোটার পর। হেড স্যার আসবেন–অন্য স্যাররাও আসবেন। তখন আমি আপনাকে ভয় দেখাব। যদি ভয় পান তাহলে আমি পাশ করব। আর যদি না পান তাহলে…
মিরখাই ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগল। আমি বললাম, কান্না বন্ধ কর মিরখাই। কোনো কান্না না। আজ তোকে আমি পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেব–এমন ভয় পাব যে তাদেরই আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। তুই আসিস সবাইকে নিয়ে। চোখ মোছ। এত কাঁদবি না। যা, বাসায় যা।
তারপর কী হলো মামা?
আজ থাক। বাকিটা কাল বললে কেমন হয় রে নীতু!
খুব খারাপ হয়। তোমাকে আজই বলতে হবে। এক্ষুনি বলতে হবে। ওরা কী করল— এলো তোমার কাছে?
হুঁ।
রাত বারোটায়?
বাবোটা এক মিনিটে। বিরাট টুতের দল নিয়ে মিরখাই উপস্থিত। সেই দলে টুতের বাবা-মাও আছেন। তারা দেখতে এসেছেন টুত পরীক্ষা পাস করতে পারে কিনা।
তুমি তখন কী করছ?
আমি ঘুমের ভান করে পড়ে আছি। নাক ডাকার মতো আওয়াজও করছি যাতে কেউ বুঝতে না পারে এটা আমার নকল ঘুম। কিন্তু আমার কান খুব সজাগ— কী হচ্ছে সব বুঝতে পারছি। জানালা দিয়ে টুত ঢুকল, সেটা বুঝলাম। টুতের স্যাররা যে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সেটাও টের পেলাম…। টুত এসে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, মামা, আমি এসেছি।
ও তোমাকে মামা ডাকে?
আগে কিছু ডাকত না। হঠাৎ ডাকা শুরু করল।
আমার মনে হয় ও তোমাকে পছন্দ করেছে বলেই মামা ডাকছে।
হতে পারে। তারপর কী হলো শোন–টুত বলল, মামা, আমি আপনাকে ভয় দেখাতে এসেছি।
আমি বললাম, ভেরি গুড। ভয় দেখানো শুরু কর।
টুত বলল, কীভাবে ভয় দেখাব মামা?
আমি বললাম, প্রথমে টান দিয়ে গা থেকে লেপটা সরিয়ে দে। তারপর আমার পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দে। সুড়সুড়ি দিতেই আমি চিৎকার করে উঠব। আমার চিৎকার শুনে তুই খিকখিক করে হাসবি। তারপর জানালাটা বন্ধ করবি। খুলবি। বন্ধ করবি। খুলবি। আমি তখন বাতি জ্বালাব। বাতি জ্বালালেই তুই নিভিয়ে দিবি। যতবার জ্বালাব ততবার তুই নিভিয়ে দিবি। বাতি নিভিয়ে খিকখিক করে হাসবি।
টুত বলল, আচ্ছা। বলেই সে করল কি–টান দিয়ে আমার গা থেকে লেপ সরিয়ে দিল।
আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। সে আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে কে! কে আমার পায়ে সুড়সুড়ি দেয়? কে কে?
আর তখন খিকখিক হাসির শব্দ শোনা যেতে লাগল। আমি ভয়ে আঁ আঁ করতে লাগলাম।
নীতু বলল, মামা, এটা তো সত্যি ভয় না, মিথ্যা ভয়। তাই না?
হ্যাঁ মিথ্যা ভয়। কিন্তু কার সাধ্য সেটা বুঝে। আমি আঁ আঁ করে চিৎকার করছি আর তখন জানালা বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। আমি চিকন স্বরে চেঁচাতে লাগলাম— ভূত ভূত ভূত। আমাকে বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও! কে কোথায় আছে? আমাকে বাঁচাও। ভূত আমাকে মেরে ফেলল! ভূত আমাকে মেরে ফেলল!