আলিশান বাড়ি মানে কী মামা?
আলিশান বাড়ি মানে রাজপ্রাসাদ।
তুমি রাজপ্রাসাদে থাকতে?
গরিবের রাজপ্রাসাদ বলতে পারিস। দুটা শোবার ঘর। বসার ঘর। টানা বারান্দা। দোতলা বাড়ি। একতলায় ট্যাক্স অফিস। দোতলায় আমি থাকি। আলো-হাওয়া খুব আসে। সমুদ্রের ওপর বাড়ি হলে যা হয়।
মামা, তুমি একটু আগে বলেছ নদীর ওপর বাড়ি।
কর্ণফুলি নদী সেখানে সমুদ্রে পড়েছে। কাজেই নদীর ওপর বললে যেমন ভুল হয় না, সমুদ্রের ওপর বাড়ি বললেও ভুল হয় না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দক্ষিণে তাকালে সমুদ্র দেখা যায়, আবার পশ্চিমে তাকালেই নদী। এখন বুঝেছিস?
হুঁ। তারপর কী হয়েছে বলো।
বাড়িটা ছিল লোকালয়ের বাইরে। দিনের বেলায় একতলার অফিসে কাজকর্ম হতো। লোকজনে গমগম করত। সন্ধ্যাবেলা সব সুনশান।
সুনশান কী মামা?
সুনশান হলো কোনো শব্দ নেই। নীরব। ভয়ঙ্কর নীরব।
তারপর?
তারপর একদিন কী হয়েছে শোনো–কাজে আটকা পড়েছিলাম, অফিস থেকে ফিরতে অনেক দেরি হলো…
অফিস বলছ কেন মামা-তুমি না স্কুলে মাস্টারি কর!
বাবারে, স্কুলেও তো অফিস আছে। ছাত্র পড়ানো শেষ করে সেই অফিসে হেড মাস্টারের সঙ্গে মিটিং করতে গিয়ে দেরি। এইজন্যেই অফিস বলছি।
ও আচ্ছা।
আমি দুপুরে বাইরে খেয়ে নিই। রাতে নিজে বেঁধে খাই। চারটা চাল ফুটাই, আলুভর্তা করি, একটা ডিম ভাজি। গাওয়া ঘি গরম ভাতের ওপর ছড়িয়ে আলুভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়ার মজাই অন্য…।
আমার আলুভর্তা আর গাওয়া ঘি দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে মামা।
এখন খাবি?
হুঁ।
একটু আগেই তো খেলি। খাওয়ার কথা শুনে ক্ষিদে পাওয়া, ভূতের কথা শুনে ভয় পাওয়া— এসব তো ভালো লক্ষণ না। এসব হলো জটিল এক রোগের লক্ষণ। রোগটার নাম হচ্ছে শোনা রোগ। এই রোগ হলে শোনা কথায় আক্কেল গুডুম হয়…।
তুমি গল্প বাদ দিয়ে অন্য কথা বলছ…
আমি অন্য কথা বলতে চাইনি, তুই-ই তো অন্য কথা নিয়ে এলি। যাই হোক, গল্প শুরু করি–কী যেন বলছিলাম, ও হ্যাঁ, আমার বাসা যে এলাকায় সে এলাকাটা সন্ধ্যার পর সুনশান নীরব হয়ে যায়। সেদিনই বাসাটা ছিল অন্যদিনের চেয়েও নীরব। হোটেলে ভাত খেয়ে যখন ফিরছি—
মামা, তুমি এক্ষুনি বললে আলুভর্তা দিয়ে গাওয়া ঘি দিয়ে ভাত খেলে?
তোকে গল্প বলাই এক যন্ত্রণা! সবটা না শুনেই জেরা শুরু করিস। পুরোটা শুনে তার পরে জেরা করবি। ঠিক করেছিলাম, বাসাতেই বেঁধে খাব। রাঁধতে গিয়ে দেখি চুলা ধরানো যাচ্ছে না। এক ফোঁটা কেরোসিন নেই। বাধ্য হয়ে হোটেলে খেতে গেলাম।
ও আচ্ছা।
হোটেলটা আবার অনেকখানি দূরে। তিন কিলোমিটার হবে। যেতে লাগে এক ঘণ্টা। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফিরছি। রাত নটার মতো বাজে। নির্জন রাস্তা। খুব হাওয়া দিচ্ছে—শীত শীত লাগছে। চাদর গায়ে ছিল। চাদর দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়ে এগুচ্ছি–হঠাৎ মনে হলো, কে যেন চাদরের খুট ধরে আমার সঙ্গে সঙ্গে এগুচ্ছে। তাকিয়ে দেখি কেউ না। নিশ্চয়ই মনের ভুল। কিন্তু আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম, যখন আমি হাঁটি কে যেন চাদরের খুট ধরে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। দাঁড়ালেই চাদরের খুট ছেড়ে দেয়। আমি হতভম্ব। ব্যাপারটা কী? চাদরে কোনো সমস্যা আছে নাকি? আমি গা থেকে চাদর খুলে ভাজ করে ছোট করলাম। ফেলে দিলাম কাঁধে। শীত লাগলে লাগুক। চাদরের খুট ধরে তো আর কেউ এখন টানাটানি করবে না। আবার হাঁটা ধরতেই ভয়ঙ্কর এক চমক খেলাম। কে যেন এখন আমার বাঁ হাতের কড়ে আঙুল ধরে হাঁটছে। অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
নীতু ভীতু গলায় বলল, মামা, কে তোমার কড়ে আঙুল ধরে হাঁটছে?
কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে যে হাঁটছে সে শক্ত হাতে আমার আঙুল চেপে ধরে আছে। মনে হচ্ছে, অল্প বয়স্ক কোনো বাচ্চা। তুলতুলে হাত। নরম আর ঠাণ্ডা। আমি ঝাকি দিয়ে হাত সরিয়ে নিলাম। দুপা এগুতেই আবার আঙুল চেপে ধরল।
নীতু কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, মামা, আমার ভয় লাগছে। জাহেদুর রহমান সাহেব বললেন–তোর আর কি ভয় লাগছে? আমার ভয় যা লাগছিল তার সীমা-পরিসীমা ছিল না। শরীর ঘেমে গেল বুক ধুকধক করতে লাগল। একবার ইচ্ছা করল উঠে দৌড় দেই।
তুমি কী করলে? দৌড় দিলে?
না, দৌড় দিলাম না। কারণ, স্যান্ডেল পুরনো, স্যান্ডেলের ফিতা নরম হয়ে আছে। দৌড় দিলেই ফিতা ছিঁড়ে যাবে। আমি সিগারেট ধরালাম।
সিগারেট ধরালে কেন মামা?
সিগারেটে আগুন আছে। আগুন থাকলে ভূত-প্রেত কাছে ভিড়ে না।
ওটা কি ভূত ছিল মামা?
না, ভূত ছিল না। ওটা ছিল টুতের বাচ্চা।
নীতু অবাক হয়ে বলল, টুতের বাচ্চা আবার কী?
জাহেদুর রহমান সাহেব বললেন, আমরা সব সময় বলি না বাঘ-টাগ, ভূত-টুত? বাঘের যেমন বাচ্ছা আছে, সেরকম আছে টাগের বাচ্চা। আবার ভূতের বাচ্চার মতো আছে টুতের বাচ্চা।
ওরা কেমন মামা?
ভয়ঙ্কর। ভূতরাই ওদের ভয়ে অস্থির, মানুষের কথা ছেড়ে দে। একটা টুতের বাচ্চা থাকলে তার ত্রিসীমানায় কোনো ভূতের দেখা পাবি না।
ওরা দেখতে কেমন?
দেখতে কেমন কী করে বলব? ওদের তো আর চোখে দেখা যায় না।
হাত দিলে বুঝা যায়?
অবশ্যই যায়।
তারপর কী হলো মামা বলো।
আমি তো ভয়ে আঁতকে উঠলাম। তবে চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললাম, কে? কে?
ধমক দিলে কেন মামা?
ভয় কাটানোর জন্যে দিলাম। খুব বেশি ভয় পেলে ধমক দিতে হয়। ধমকের জোর যত বেশি হয় ভয়ও তত কমে।