তুমি চলে যাও। আমার অঙ্ক শেষ করতে হবে।
কঠিন অঙ্ক?
হুঁ কঠিন।
খুব কঠিন?
হুঁ। খুব কঠিন।
কঠিন অঙ্ক সহজ করার একটা মন্ত্র আছে। সেটা শিখিয়ে দিব? যে-কোনো কঠিন অঙ্কের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রটা পড়ে দুবার ফুঁ দিলেই অঙ্ক সহজ হয়ে যাবে, চট করে করতে পারবি। দেব শিখিয়ে?
তুমি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছ কেন? তুমি কি ভেবেছ আমি বোকা? আমি মোটেই বোকা নই।
মন্ত্র শিখবি না?
না শিখব না। আর শোনো আমাকে তুই তুই করবে না।
ছেলেটা ফিসফিস করে বলল–তুই এমন রেগে আছিস কেন? রাগ করা তো ভালো না। আচ্ছা শোন, রাগ কমাবার মন্ত্র আমার কাছ থেকে শিখবি? এই মন্ত্রটা খুব সহজ। হাত মুঠো করে এই মন্ত্র একবার পড়লেই রাগ কমে যায়। নিজের রাগ তো কমেই আশপাশে যারা আছে তাদের রাগও কমে। মনে কর তোর বাবা খুব রাগ করেছেন—তুই হাত মুঠো করে একবার মন্ত্রটা পড়বি–দেখবি মজা। তোর বাবার সব রাগ পানি হয়ে যাবে। তাকে হাসি মুখে কোলে তুলে নিবে।
বাবলু বলল, তুমি যাও তো।
চলে যাব?
হ্যাঁ চলে যাবে এবং আর কোনো দিন আসবে না।
আচ্ছা চলে যাচ্ছি। একটা খাতা আর কলম আন—চট চট করে মন্ত্রগুলি লিখে ফেল। আমি একবার চলে গেলে আর আমাকে পাবি না।
তোমাকে আমার দরকারও নেই।
সত্যি চলে যাব?
হ্যাঁ চলে যাবে।
আচ্ছা চলে যাচ্ছি। তুই মন খারাপ করে বসেছিলি দেখে এসেছিলাম— আমি কে জানিস?
জানতে চাই না।
আমি হচ্ছি ভূত রাজার ছেলে। ভূতদের সব মন্ত্র আমি জানি। খাতাটা দে–অদৃশ হবার মন্ত্রটা লিখে রেখে যাই। চোখ বন্ধ করে তিনবার এই মন্ত্রটা পড়লেই অদৃশ্য হয়ে যাবি। আর কেউ তোকে দেখতে পাবে না।
তুমি যাও তো।
ছেলেটা মন খারাপ করে চলে গেল। বাবলু দরজা বন্ধ করে আবার অঙ্ক নিয়ে বসল। কী যে কঠিন সব অঙ্ক! বাবলু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। অঙ্ক সহজ করার কোনো মন্ত্র থাকলে ভালোই হতো।
রান্নাঘর থেকে বুয়া চেঁচিয়ে বলল, দুধ খাইছ?
বাবলু বলল, না।
তাড়াতাড়ি খাও। না খাইলে তোমার আব্বার কাছে নালিশ দিমু।
নালিশ দিতে হবে না, খাচ্ছি।
বাবলু দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। দুধ কোথায়? গ্লাস ভর্তি পেপসি। বরফের দুটা টুকরাও ভাসছে। বাবলু ভয়ে ভয়ে একটা চুমুক দিল।
হ্যাঁ সত্যি সত্যি পেপসি। কী ঝাঁঝ! মন্ত্র তাহলে সত্যি আছে?
বাবলু ছুটে ঘর থেকে বের হলো। ছেলেটাকে কোথাও পাওয়া গেল না। ফ্ল্যাটের দারোয়ান বলল, লাল শার্ট পরা একটা ছেলেকে সে শিস দিতে দিতে রাস্তার ফুটপাত ধরে এগিয়ে যেতে দেখেছে। এর বেশি সে আর কিছু জানে না।
মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ
নীলগঞ্জ হাই স্কুলের হেড মাস্টার জাহেদুর রহমান সাহেব নীতুর বড় মামা। বড় মামাকে নীতুর খুব পছন্দ। তিনি অন্যসব হেড মাস্টারের মতো না পড়া ধরেন না, গম্ভীর হয়ে থাকেন না, একটু হাসাহাসি করলেই বিরক্ত হন না। গল্প বলতে বললে গল্প শুরু করেন। সুন্দর সুন্দর গল্প, তবে নীতুর ধারণা, বানানো গল্প।
বানানো গল্প শুনতে নীতুর ভালো লাগে না। তার সঙ্গি গল্প শুনতে ইচ্ছে করে। সে গল্প শুনতে চায় কিন্তু প্রথমেই বলে নেয়— সত্যি গল্প বলতে হবে।
আজ নীতুর মামা জাহেদুর রহমান সাহেব একটা ভূতের গল্প শুরু করেছেন। তাঁর সামনে এক বাটি মুড়ি। বড় চায়ের কাপে এক কাপ চা। তিনি মুড়ি খাচ্ছেন এবং চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। নীতু তার সামনেই উপুড় হয়ে আছে। দুহাত দিয়ে মাথা তুলে রেখেছে। খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে এবং বোঝার চেষ্টা করছে মামা সত্যি গল্প বলছেন না মিথ্যা গল্প বলছেন। মিথ্যা গল্প হলে সে শুনবে না।
নীতুর বয়স বেশি না। এবার ক্লাস থ্রিতে উঠেছে। তবে তার খুব বুদ্ধি। গল্পের সত্যি-মিথ্যা সে চট করে ধরে ফেলে। ঐ তো সেদিন কাজের বুয়া তাকে গল্প বলেছে—
একদেশে ছিল একটা বাঘ। মাঘ মাসের শীতে বাঘ হইছে কাহিল।
কাপড়ের দোকানে গিয়ে বলছে, মিয়া ভাই, আমারে একখানা গরম চাদ্দর দেন। শীতে কষ্ট পাইতাছি…
নীতু বুয়াকে কড়া করে ধমক দিয়েছে। সে কঠিন গলায় বলেছে, মিথ্যা গল্প বলতে নিষেধ করেছি। এটা তো মিথ্যা গল্প।
বুয়া অবাক হয়ে বলেছে, কোনটা মিথ্যা?
বাঘ কি কথা বলতে পারে? বাঘ কি দোকানে যেতে পারে?
কথা তো সত্য বলছেন আফা… কিন্তু…
থাক বুয়া, তোমাকে গল্প বলতে হবে না।
নীতু খুব সাবধানী। কেউ তাকে ঠকাতে পারে না। বড় মামাও পারবেন না, চেষ্টা করলেও না। সে ঠিক ধরে ফেলবে।
নীতু বলল, কই বড় মামা, তারপর কী হলো বলো।
জাহেদুর রহমান সাহেব বলবেন, মুড়ি খেয়ে নিই।
উঁহুঁ, তুমি খেতে খেতে বলো।
জাহেদ সাহেব চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, তখন আমার যুবক বয়স। চাকরির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। খবর পেলাম, চিটাগাং পোর্টের স্কুলে একজন…
মামা, মিথ্যা গল্প না তো?
অসম্ভব। আমি মিথ্যা গল্প বলি কীভাবে? স্কুলের হেড মাস্টার মিথ্যা বলে কখনো শুনেছিস?
আচ্ছা বেশ, বলো?
কতদূর বলেছি? তোমার তখন যুবক বয়স…
ও হ্যাঁ, খবর পেলাম, চিটাগাং পোর্টের স্কুলে ইংরেজি একজন শিক্ষক নেবে…
মামা, তুমি কিন্তু একটু আগে বলেছ অঙ্কের শিক্ষক। তুমি মিথ্যা গল্প শুরু করেছ।
আরে না, ওরা একজন শিক্ষক নেবে। তাকে অঙ্ক-ইংরেজি দুটো পড়াতে হবে। এখন বুঝলি?
হুঁ।
ইন্টারভিউ দিলাম। চাকরি হয়ে গেল। ভালো বেতন। কর্ণফুলি নদীর ওপর বিরাট বাসা ভাড়া করলাম। তখন বাড়ি-ভাড়া ছিল সস্তা। দু শ-তিন শ টাকায় আলিশান বাড়ি পাওয়া যেত।