জয়নাল অনেক কষ্টে চোখ মেলে বলল, স্যার, ভালো আছি।
ভালো আছি বলছিস কোন আন্দাজে? তুই তো মরতে বসেছিস রে গাধা।
জয়নাল থেমে থেমে বলল, আপনারে একটা ঘটনা বলব স্যার। ঘটনাটা না বললে মনটা শান্ত হইব না।
কী ঘটনা?
পানির উপরে দিয়া হাঁটনের ঘটনা। আমি স্যার সাধু না, পির-ফকিরও না, কিন্তু আমি…।
জয়নাল হাঁপাতে লাগল। তার কপাল দিয়ে টপটপ করে ঘাম পড়তে লাগল। মবিন সাহেব বললেন, এখন বিশ্রাম কর তো। তোর ঘটনা সবই শুনব।
আপনে স্যার জ্ঞানী মানুষ, আপনে শুনলে বুঝবেন। যা বলব সবই সত্য। আমি জীবনে মিথ্যা বলি নাই। আমি স্যার পানির উপরে দিয়া হাঁটতে পারি। খালি পায়ের পাতা ভিজে আর কিছু হয় না। বিরাট রহস্য স্যার…।
শুনব, তোর বিরাট রহস্য মন দিয়ে শুনব। এখন ঘুমুতে চেষ্টা কর। তোর শরীরের যে অবস্থা দেখছি…
কুত্তাটার জন্যে মনটা টানে স্যার। পাও ভাঙা, নিজে যে হাঁইট্যা-চইড়া খাইবে সেই উপায় নাই। কেউ দিলে খায়, না দিলে উপাস থাকে। বোবা প্রাণী, কাউরে বলতেও পারে না।
আচ্ছা, আমি কুকুরটার খোঁজ নিব।
আপনের অসীম মেহেরবানি।
তুই নাকি কাকদের পাউরুটি ছিঁড়ে খাওয়াস, এটা সত্যি নাকি?
জয়নাল লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। মবিন সাহেব বললেন, কাককে পাঁউরুটি খাওয়ানোর দরকার কী? ওদের তো আর খাবারের অভাব হয়নি। ওদের ডানাও ভাঙেনি।
জয়নাল বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, কাউয়ারে কেউ পছন্দ করে না। আদর কইরা কাউয়ারে কেউ খাওন দেয় না। এই ভাইব্যা…
আচ্ছা, ঠিক আছে। তুই আর কথা বলিস না। শুয়ে থাক। আমি কাল এসে আবার খোঁজ নেব।
আপনের মতো দয়ার মানুষ আমি আর এই জীবনে দেখি নাই। জয়নালের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।
.
মবিন সাহেব পরদিন তাকে আবার দেখতে গেলেন। অবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়েছে। চোখ লাল। বুক যেভাবে ওঠা-নামা করছে তাতে মনে হয় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। রাতে ডাক্তাররা অক্সিজেন দেবার চেষ্টা করেছেন। তাতে তার খুব আপত্তি। কিছুতেই সে নাকের ওপর বাটি ধরবে না। আমি বললাম, কেমন আছিস রে জয়নাল?
জয়নাল ফ্যাঁসফ্যাঁস গলায় বলল, খুব ভালো আছি স্যার। খুব ভালো। ঘটনাটা বলব?
কী ঘটনা?
পানির উপরে দিয়া হাঁটনের ঘটনা। না বইল্যা যদি মইরা যাই তা হইলে একটা আফসোস থাকব। বলি—? কাছে আইস্যা বসেন। আমি জোরে কথা বলতে পারতেছি না।
মবিন সাহেব কাছে এসে বসলেন। জয়নাল ফিসফিস করে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলতে লাগল–
ছোটবেলা থাকাই স্যার আমি পানি ভয় পাই। বেজায় ভয়। আমি কোনো দিন পুসকুনিতে নামী নাই, নদীতে নামী নাই। একবার মামারবাড়ি গিয়েছি, মামার বাড়ি হলো সান্দিকোনা–বাড়ির কাছে নদী। খুব সুন্দর নদী। আমি সন্ধ্যাকালে নদীর পাড় দিয়া হাঁটাহাঁটি করি। একদিন হাঁটতেছি— হঠাৎ শুনি খচমচ শব্দ। নদীর ঐ পাড়ে একটা গরুর বাচ্চা পানিতে পড়ে গেছে। গরু-ছাগল এরা কিন্তু স্যার জন্ম থাইক্যা সাঁতার জানে। এরা পানিতে ডুবে না। কিন্তু দেখলাম, এই বাচ্চাটা পানিতে ডুইব্যা যাইতেছে। একবার ডুবে, একবার ভাসে। পায়ের মধ্যে দড়ি পেঁচাইয়া কিছু একটা হইছে। বাচ্চাটা এক একবার ভাইস্যা উঠে আমার দিকে চায়। আমাকে ডাকে। তার ডাকের মধ্যে কী যে কষ্ট। আমার মাথা হঠাৎ আউলাইয়া গেল। আমি যে সাঁতার জারি ঘা, পানি ভয় পাই কিছুই মনে রইল না দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে বাচ্চার কাছে গিয়া উপস্থিত। পানি থাইকা বাচ্চাটারে টাইন্যা তুইল্যা দেহি আমি নিজে পানির উপরে দাঁড়াইয়া আছি। আমি নদী পার হইছি হাইট্যা, আমার পায়ের পাতাটা খালি ভিজছে। আর কিচ্ছু ভিজে নাই–এখন স্যার আপনে আমারে বলেন বিষয় কী? ঘটনা কী?
মবিন সাহেব বললেন, এরকম কি আরো ঘটেছে?।
জে না, সেই প্রথম, সেই শেষে। আর কোনো দিন আমি পানিতে নামী নাই। এখন আপনে যদি বলে আরেকবার পানিতে নাইম্যা দেখব। তয় আমি তো সাধুও না— পীর-ফকিরও না…
মবিন সাহেব বলেলেন, কে বলতে পারে! তুই হয়তো বিরাট সাধু–তুই নিজে তা জানিস না।
জয়নাল কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি স্যার সাধারণ মানুষ। অতি সাধারণ, তয় স্যার, সাধু হইতে আমার ইচ্ছা করে। খুব ইচ্ছা করে।
মবিন সাহেব বললেন, আর কথা বলিস না জয়নাল। তোর কষ্ট হচ্ছে, শুয়ে থাক।
আমার কুত্তাটারে পাইছিলেন?
খোঁজ করছি— এখনও পাইনি। পেলে ভাত খাইয়ে দেব। চিন্তা করিস না। রাতে এসে খোঁজ নিয়ে যাব।
জয়নাল হাসল। তৃপ্তির হাসি, আনন্দের হাসি।
রাতে খোঁজ নিতে এসে মবিন সাহেব শুনলেন জয়নাল মারা গেছে। মবিন, সাহেব অত্যন্ত মন খারাপ করে হাসপাতালের বারান্দায় এসে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন রাজ্যের কাক বারান্দায় লাইন বেঁধে বসে আছে। তাদের চেয়ে একটু দূরে বসে আছে কোমরভাঙা কুকুর। কীভাবে সে এতদূর এসেছে কে জানে?
মবিন সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। এই জগতে কত রহস্যই না আছে! কোনো দিন কি এইসব রহস্যভেদ হবে?
ভূত মন্ত্র
বাবলুকে একা বাসায় রেখে তার বাবা-মা ভৈরবে বেড়াতে গেছেন। সকালের ট্রেনে গেছেন, ফিরবেন রাত নটায়। এই এত সময় বাবলু একা থাকবে। না, ঠিক একা না, বাসায় কাজের বুয়া আছে।
বাবলুর খুব ইচ্ছা ছিল সেও ভৈরব যাবে। অনেক দিন সে ট্রেনে চড়ে না। তার খুব ট্রেনে চড়তে ইচ্ছা করছিল। তা ছাড়া ভৈরবে ছোট খালার বাড়িতেও অনেক মজা হবে। ছোটখালার বাড়িটা নদীর ওপরে। নিশ্চয়ই নৌকায় চড়া হবে। বাবলু অনেক দিন নৌকাতেও চড়ে না। তাকে ইচ্ছে করলেই নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু বাবলুর বাবা মনসুর সাহেব তাকে নেবেন না। তিনি চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, নো নো নো। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেড়ানো আমি পছন্দ করি না। তুমি বাসায় থাক। হোম ওয়ার্ক শেষ কর।