এতদিন ঠাণ্ডায় চলাফেরা করে জয়নালের কিছু হয়নি। গরম কোর্ট পাবার তিন দিনের মাথায় তার ঠাণ্ডা লেগে গেল। প্রথমে সর্দি-জ্বর, তারপর একেবারে শয্যাশায়ী। খবর পেয়ে মবিন সাহেব দেখতে গেলেন। খুপড়ি ঘরের এক কোনায় সে চটের ওপর পড়ে আছে। তার গায়ে কোট। কোট পেয়েই সে যে গায়ে দিয়েছে আর বোধহয় খুলেনি। অন্যপাশে হাপরের গনগনে আগুন। এরকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পশুও থাকতে পারে না। মবিন সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, কেমন আছিস রে?
জয়নাল হাসিমুখে বলল, খুব ভালো আছি স্যার।
এই বুঝি তোর ভালো থাকার নমুনা? গায়ে জ্বর আছে?
জে না।
মবিন সাহেব জয়নালের কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন, গা পুড়ে যাচ্ছে!
চিকিৎসা কি হচ্ছে?
জয়নাল জবাব দিল না। তার মানে চিকিৎসা কিছু হচ্ছে না। অবস্থা যা তাতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। মবিন সাহেবের পক্ষে রোগী নিয়ে টানাটানি করাও সম্ভব না। তার নিজের কাজকর্ম আছে।
তোর আত্মীয়স্বজন এখানে কে আছে?
কেউ নাই স্যার।
খাওয়া-দাওয়া কে দিয়ে যায়?
চায়ের দোকানের একটা ছেলে আছে, ইয়াকুব নাম, হে দেয়। বড় ভালো ছেলে। অন্তরে খুব মুহব্বত।
ছেলেটাকে বলবি আর সঙ্গে যেন দেখা করে।
জি আচ্ছা।
চিন্তা করিস না তোর চিকিৎসার ব্যবস্থা আমি করব।
জয়নালের চোখে পানি এসে গেল। মানুষ এত ভালো হয়! সে শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বলল, স্যারের কাছে একটা আবদার ছেল।
বল কী আবদার?
ঐ গল্পটা যদি আরেকবার বলতেন। গল্পটা শোনার জন্যে মন টানতাছে।
কোন গল্প?
পানির উপরে দিয়ে যে হাঁটতো।
ঐ গল্প তো শুনেছিস, আবার কেন?
শুনতে মন চায়।
জ্বরে মরে যাচ্ছিস, গল্প শুনতে হবে না। বিশ্রাম কর। ঘুমুতে চেষ্টা কর।
জে আচ্ছা।
পরে দিয়া গুম না স্যার, ঘটনা
মবিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, জয়নাল বলল, স্যার, আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারার জন্যে পানির উপরে দিয়া হাঁটা কি আল্লাপাক নিষেধ কইরা দিছে?
নিষেধ-টিষেধ কিছু না। মানুষ পানির ওপর দিয়ে হাঁটতে পারে না, কিন্তু মাকড়সা পারে। আবার মানুষ উড়তে পারে না কিন্তু পাখি উড়তে পারে। একেক জনের জন্যে একেক ব্যবস্থা এই হলো ব্যাপার।
জয়নাল চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলল, কিন্তু স্যার, কেউ-কেউ পানির উপরে দিয়া হাঁটতে পারে।
মবিন সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, না তো। মানুষ আবার পানির ওপর দিয়ে হাঁটবে কি! তা ছাড়া তার দরকারইবা কি? মানুষের জন্যে নৌকা আছে। জাহাজ আছে।
তারপরও স্যার কেউ-কেউ পানির উপরে হাঁটে। আপনে নিজেই বলছেন।
আরে গাধা, আমি যা বলেছি সেটা হলো গল্প।
জয়নাল বিছানায় উঠে বসল। উত্তেজিত গলায় বলল, গল্প না স্যার, ঘটনা সত্য। কোনো কোনো মানুষ পানির উপরে দিয়া হাঁটতে পারে, কিছু হয় না, খালি পায়ের পাতাটা ভিজে।
চুপ করে ঘুমা তো, গাধা।
জয়নাল কাতর গলায় বলল, হাত জোড় কইরা আপনেরে একটা কথা বলি স্যার। আমি নিজেই পানির উপর দিয়ে হাঁটতে পারি। সত্যই পারি। এই কথা কোনো দিন কেউরে বলি নাই, আইজ আপনেরে বললাম। স্যার, ঘটনাটা আপনেরে বলি?
মবিন সাহেব অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, আচ্ছা আজ থাক, আরেক দিন শুনব।
আমার খুব শখ বিষয়টা আপনেরে বলি। আপনে হইলেন জ্ঞানী মানুষ, আপনে বুঝবেন। বড়ই আচানক ঘটনা।
ঘটনা আরেক দিন শুনব। আজ সময় নেই। রাতের ট্রেনে নেত্রকোনা যাব। জি আচ্ছা, স্যার।
মবিন সাহেব জয়নালের কথার কোনো গুরুত্ব দিলেন না। প্রবল জ্বরে মাথা চড়ে গিয়েছে। আবোল-তাবোল বকছে। মবিন সাহেব বললেন, জয়নাল, আমি যাচ্ছি, চায়ের দোকানের ছেলেটা আসলে পাঠিয়ে দিস। রাত দশটার আগেই যেন আসে। দশটার সময় আমি চলে যাব।
জি আচ্ছা, স্যার।
চায়ের দোকানের কোনো ছেলে মবিন সাহেবের কাছে এলো না। তিনি চলে গেলেন নেত্রকোনা। তিন দিন পার করে ফিরলেন। এসেই জয়নালের খোঁজ নিলেন। সে আগের জায়গায় নেই। জ্বর প্রবল হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কামারশালার মালিক সতীশ বলল, অবস্থা সুবিধার না। শ্বাসকষ্ট হইতেছে।
মবিন সাহেব বললেন, ডাক্তার কী বলল? ওর হয়েছে কী?
নিওমোনিয়া। খুব খারাপ নিওমোনিয়া। ডাক্তার বলছে বাঁচে কিনা বাঁচে ঠিক নাই। তবে চিকিৎসা হইতেছে।
বলো কি!
স্যার, জয়নাল হইল গিয়া আফনের পাগলা কিসিমের মানুষ। শইলের কোনো যত্ন নাই। আমার এইখানে আছে দশ বছর। এই দশ বছরে তারে গোসল করতে দেখি নাই। পানির বিষয়ে তার নাকি কি আছে। সে পানির ধারে কাছে যায় না।
যায় না কেন?
কিছু বলে না, খালি হাসে। তবে স্যার, পাগল কিসিমের লোক হইলেও মানুষ ভালো। ধরেন, আমার এইখানে পইড়া ছিল পেটেভাতে। ব্যাবসাপাতি নাই, তারে কী দিমু কন। নিজেই চলতে পারি না। কিন্তু স্যার, এই নিয়া কোনো দিন একটা কথা সে আমারে বলে নাই। আমারে না জানাইয়া সে মাঝে মাঝে ইস্টিশনে কুলির কাম করতো। হেই পয়সা দিয়া তর্ক করতো জানেন স্যার?
কী করতো?
দুনিয়ার যত কাউয়ারে পাঁউরুটি কিন্যা খাওয়াইতো।
কেন?
বললাম না স্যার, পাগল কিসিমের লোক। তয় মনটা পানির মতো পরিষ্কার।
মবিন সাহেব তাকে হাসপাতালে দেখতে গেলেন। বিছানায় মরার মতো পড়ে আছে। জ্বরে আচ্ছন্ন। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুক কামারের হাপরের মতোই ওঠানামা করছে। মবিন সাহেব বললেন, কেমন আছিস রে জয়নাল?