জয়নাল মাথা চুলকাতে লাগল। পায়ের বুড়ো আঙুলে নকশা কাটা আরো দ্রুত হলো। বার কয়েক খুকখুক করে কাশল।
কিছু বলার থাকলে বলে ফেল। এত লজ্জা কীসের?
ঐ গল্পটা আবার শুনতে আইছি।
মবিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন গল্প?
পানির উপরে দিয়া যে হাঁটে…
একবার তো শুনেছিস, আবার কেন?
মনটা টানে।
মবিন সাহেব তাঁর নাতনিদের টলস্টয়ের বিখ্যাত একটা গল্প বলেছিলেন। যে গল্পে কয়েক জন বেঁটে ধরনের সাধুর কথা আছে। তারা এক নির্জন দ্বীপে বাস করতো, নিজেদের মতে করে আল্লাহর নাম-গান করতো। সমুদ্রের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে যাবার অদ্ভুত ক্ষমতা তাদের ছিল। এই গল্প জয়নালও শুনেছে। বোকা মানুষ, হয়তো ভালো করে বুঝতে পারেনি। এখন ভালোমতো বুঝতে চায়।
মবিন সাহেব বললেন, বস আমার সামনে, গল্পটা আবার বলি।
জয়নাল বসল। মবিন সাহেবের কাছ থেকে খুরপাই টেনে নিয়ে মাটি কুপাতে লাগল। তাকে নিষেধ করে লাভ হবে না। সে কাজ না করে থাকতে পারে না। সে যতবার আসে এটা-সেটা করে দেয়।
মবিন সাহেব গল্প শুরু করলেন। জয়নাল নিবিষ্ট মনে শুনছে। গল্প শেষ হবার পর সে নিশ্বাস ফেলে বলল, উনারা সাধু ছিলেন?
হ্যাঁ, সাধু ছিলেন। সাধারণ মানুষ তো আর পানির ওপর হাঁটতে পারে না।
পারে না কেন স্যার?
মানুষের ওজন পানির চেয়ে বেশি। আর্কিমিডিসের একটা সূত্র আছে। তুই তো বুঝবি না। লেখাপড়া না জানলে বুঝানো মুশকিল।
জয়নাল বিনীত গলায় বলল, আমি লেখাপড়া জানি। ক্লাস থিরি পাস করছিলাম। পাঁচের ঘরের নামতা জানি।
পাঁচের ঘরের নাম জানলে হবে না, আরো পড়াশোনা জানা লাগবে।
জি আচ্ছা। স্যার আইজ উঠি।
আচ্ছা যা।
জয়নাল উঠে দাঁড়াল তবে চলে গেল না। আবারো খুকখুক করে কাশতে লাগল। মনে হচ্ছে সে আরো কিছু বলতে চায়। মবিন সাহেব বললেন, কিছু বলবি?
জয়নাল বিব্রত গলায় বলল, সাধু হওয়ার নিয়মটা কী?
কেন, তুই কি সাধু হতে চাস নাকি?
জয়নাল মাথা নিচু করে ফেলল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে সাধু হতে চায়।
মবিন সাহেব বললেন, সাধু হওয়া বড়ই কঠিন। নির্লোভ হতে হয়। পরের মঙ্গলের জন্যে জীবন উৎসর্গ করতে হয়। তারা কখনও মিথ্যা বলে না। সাধারণ মানুষ মিথ্যা না বলে থাকতে পারে না। সামান্য হলেও মিথ্যা বলতে হয়।
জয়নাল প্রায় ফিসফিস করে বলল, স্যার, আমি মিথ্যা বলি না।
ভালো। খুব ভালো।
আমার কোনো লোভও নাই।
মবিন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তুই তো তাহলে সাধুর পর্যায়ে চলেই গেছিস।
জয়নাল লজ্জা পেয়ে বলল, স্যার যাই?
আচ্ছা যা। আরে শোন শোন, একটু দাঁড়া।
মবিন সাহেব ঘর থেকে একটা পুরনো কোট এনে দিলেন। কোটের রঙ জ্বলে গেছে, হাতের কাছে পোকায় কেটেছে। তবু বেশ গরম। জয়নাল ব্যবহার করতে পারবে। মবিন সাহেব লক্ষ করেছেন এই শীতেও জয়নাল পাতলা একটা জামা পরে থাকে। খালি পায়ে হাঁটে।
জয়নাল কোট পেয়ে অভিভূত হয়ে গেল। তার চোখে পানি এসে গেল। সে নিচু হয়ে মবিন সাহেবকে কদমবুসি করল।
কোট যেদিন দিলেন সেদিন সন্ধ্যাতেই মবিন সাহেবের সঙ্গে জয়নালের আবার দেখা। কোট গায়ে দিয়ে জয়নাল একেবারে ফিটফাট বাবু। সে রাস্তার মোড়ে উবু হয়ে বসে একটা কুকুরকে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে। ফিসফিস করে কুকুরকে বলছে, খা বাবা খা। কষ্ট কইরা খা। পরের বার তোর জন্যে গোস্ত যোগাড় করব। না খাইলে শইল্যে বল হইব না।
মবিন সাহেব ধমকে দাঁড়ালেন।
কী করছিস রে জয়নাল?
কিছু না স্যার।
কুকুরকে পাঁউরুটি খাওয়াচ্ছিস, ব্যাপারটা কী?
এ স্যার হাঁটাচলা করতে পারে না। দুইটা ঠেং ভাঙা, লুলা হইয়া আছে। ঠেং-এর ওপর দিয়া গাড়ি চইল্যা গেল।
তুই কি রোজ একে খাইয়ে যাস?
মবিন সাহেব দেখলেন কুকুরটার আসলেই অন্তিম দশা। মনে হচ্ছে শুধু পা, কোমরও ভেঙেছে। নিম্ন শ্রেণীর বলেই এখনও বেঁচে আছে। মানুষ হলে মরে যেত।
জয়নাল কিছু বলল না। হাসল। মবিন সাহেব বললেন, পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে তুলে দেবার দরকার কী? সামনে ফেলে দে— নিজেই খাবে।
জি আচ্ছা।
জয়নাল পাউরুটি ফেলে মবিন সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল। মবিন সাহেব বললেন, কোটে শীত মানে?
জে স্যার, মানে।
কোট গায়ে দিয়ে খালি গায়ে হাঁটাহাঁটি ভালো দেখায় না। এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে নিস।
জে আচ্ছা।
বাসায় আসিস। পুরনো এক জোড়া জুতা দিয়ে দেব। তোর পায়ে লাগলে হয়। তোর যা গোদা পা!
জয়নাল হেসে ফেলল। গোদা পা বলায় সে মনে হলো খুব আনন্দ পেয়েছে। মবিন সাহেব বললেন, তুই আমার পেছনে পেছনে আসছিস কেন?
স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব।
জিজ্ঞেস করা।
উনাদের নাম কী স্যার?
কাদের নাম কী? পরিষ্কার করে বল।
সাধু। যারা পানির ওপর দিয়ে হাঁটে।
এখনও সেই গল্প মাথায় ঘুরছে? সাধুদের কোনো নাম দেয়া নেই, তবে যিনি এই গল্প লিখেছেন তাঁর নাম টলস্টয়। মস্ত বড় লেখক।
বড় তো স্যার হইবই। সত্য কথা লেখছে। পানির উপরে হাঁটা সহজ ব্যাপার তো না। আচ্ছা স্যার, এই দুনিয়ায় সর্বমোট কয়জন লোক আছে যারা পানির উপরে হাঁটতে পারে?
মবিন সাহেব উত্তর দিলেন না। বোকা লোকদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। উত্তর দিতে গেলে ঝামেলায় পড়তে হবে। জয়নালও উত্তরের জন্যে চাপাচাপি করল না। মবিন সাহেবকে তাঁর বাড়ির গেট পর্যন্ত আগিয়ে দিল।