খিদে নেই বাবা।
সিনেমা দেখবে মা? চলো একটা সিনেমা দেখে আসি।
না।
গল্পের বই কিনবে? চলো বই কিনে দিই।
চাই না গল্পের বই।
লাল জুতো কিনতে চেয়েছিলে, চলো কিনে দেব।
আমার কিছু চাই না বাবা। নীলু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
সেই রাতে খুব জ্যোৎস্না হয়েছে। ছোট কাকু ছাদে মাদুর পেতে শুয়েছেন। নীলুও তার ছোট্ট বালিশ এনে শুয়েছে তার কাকুর পাশে। কাকু নীলুর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, হাতীটার জন্যে তোমার খুব খারাপ লাগছে মা?
হ্যাঁ।
আমারও লাগছে। টিটোর শখ মিটে গেলে আমরা ঐ হাতী নিয়ে আসব, কেমন?
নীলু চুপ করে রইল।
ছোট কাকু বললেন, গল্প শুনবে মা?
বলো।
কিসের গল্প শুনবে?
নীলু মৃদু স্বরে বলল, হাতীর গল্প।
ছোট কাকু বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে গল্প শুরু করলেন।
আমাদের গ্রামের বাড়ি হিরণপুরে রহিম শেখ নামে খুব ধনী এক লোক ছিলেন। তার একটি মাদি হাতী ছিল।
সত্যিকারের হাতী কাকু?
হ্যাঁ মা। প্রকাণ্ড হাতী। রহিম শেখ খুব ভালোবাসত হাতীটাকে। ঠিক তোমার মতো ভালোবাসত।
সেই হাতীটার গায়ের রঙ কি নীল?
মা, মেটে রঙের হাতী ছিল সেটি। তারপর একদিন হঠাৎ করে হাতীটা পালিয়ে গেল গারো পাহাড়ে। চার বছর আর কোনো খবর পাওয়া গেল না। রহিম শেখ কত জায়গায় যে খোঁজ করল! কোনো খবর নেই। হাতীর শোকে অস্থির হয়ে গিয়েছিল সে। রাতে ঘুমুতো না। শুধু বলত, আমার হাতী যদি রাতে ফিরে আসে?
তারপর এক রাতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হলো। বাতাসের গর্জনে কান পাতা দায়। এমন সময় রহিম শেখ শুনল, কে যেন তার ঘরের দরজা ঠেলছে। রহিম শেখ চেঁচিয়ে বলল, কে? আমনি ঝড়ের গর্জন ছাপিয়ে হাতী ডেকে উঠল। রহিম শেখ হতভম্ব হয়ে দেখল, চার বছর পর হাতী ফিরে এসেছে। তার সঙ্গে ছোট্ট একটা বাচ্চা। আশপাশের গ্রামের কত লোক যে সেই হাতী দেখতে এলো!
তুমি গিয়েছিলে?
হ্যাঁ মা, গিয়েছিলাম। হাতীর বাচ্চাটা ভীষণ দুষ্ট ছিল। পুকুরে নেমে খুব ঝাঁপাঝাঁপি করত। দরজা খোলা পেলেই মানুষের ঘরে ঢুকে চাল-ডাল ফেলে একাকার করত। কিন্তু কেউ কিছু বলত না। সবাই তার নাম দিয়েছিল ‘পাগলা মিয়া’।
গল্প শুনে নীলুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। সে ফিসফিস করে বলল, সত্যিকার হাতী হলে আমারটাও ফিরে আসত, তাই না চাচা?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসত। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমুতে যাও মা।
নীলুর কিন্তু ঘুম এলো না। বাইরে জ্যোৎস্নার ফিনিক ফুটেছে। বাগানে হাসনুহানার গাছ থেকে ভেসে আসছে ফুলের গন্ধ। নীলুর মন কেমন করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে অনেক রাত হলো। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে সারা বাড়ি নিচুপ হয়ে গেল। নীলু কিন্তু জেগেই রইল। তারপর সেই আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটল। নীলু শুনতে পেল নীচের বাগানে টুন টুন ঝুন ঝুন শব্দ হচ্ছে। রহিম শেখের হাতীর মতো তার হাতীটাও ফিরে এসেছে নাকি? হাতীর গলার ঘণ্টার শব্দ বলেই তো মনে হয়জানালা দিয়ে কিছু দেখা যায় না। নীলু কি তার। মাকে ডেকে তুলবে? কিন্তু মা যদি রাগ করেন, নীলু হয়তো ভুল শুনছে কানে। হয়তো এটা ঘন্টার শব্দ নয়। ভুল হবার কথাও তো নয়। চারদিক চুপচাপ, এর মধ্যে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে টুন টুন ঝুনঝুন শব্দ।
নীলু পা টিপে টিপে নীচে নেমে এলো। দরজার উপরের ছিটকিনি লাগানো। সে চেয়ার এনে তার উপর দাঁড়িয়ে খুলে ফেলল দরজা। তার ভয় করছিল। তবু সে নেমে গেল বাগানে। করে ঘণ্টা বাজিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। হাতীটি নীলুকে দেখেই পরিষ্কার মানুষের মতো গলায় বলে উঠল, আমি এসেছি নীলু। অনেকক্ষণ নীলুর মুখে কোনো কথা ফুটল না। হাতী বলল, আরো আগেই আসতাম। পথঘাট চিনি না, তাই দেরি হলো। তুমি খুশি হয়েছ তো বন্ধু!
নীলু গাঢ় স্বরে বলল, হ্যাঁ।
আমিও খুশি হয়েছি। টিটো যখন আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি। কেঁদেছি।
নীলু হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে চুমু খেল তার বন্ধুকে। আনন্দে হাতী টুন টুন ঝুনঝুন করে অনবরত তার ঘণ্টা বাজাতে লাগল। নীলু গলা ফাটিয়ে ডাকল, মা আমার নীল হাতী এসেছে।
দুপুররাতে জেগে উঠল বাড়ির লোকজন। বাবা বললেন, মনে হয় হাতীটা ঐ ছেলেটির হাত থেকে বাগানে পড়ে গিয়েছিল।
মা বললেন, আচ্ছা সাহস তো মেয়ের এত রাতে একা বাগানে এসেছে।
নীলু মার কোলে মুখ গুঁজে বলল, মা আমার হাতী একা একা টিটোদের বাসা থেকে হেঁটে চলে এসেছে। আমাকে সে নিজে বলেছে।
বাসার সবাই হেসে উঠল। বাবা বললেন, ছি মা, আবার মিথ্যে কথা বলছ? কিন্তু বাবা তো জানেন না, নীলু একটুও মিথ্যা বলেনি।
পানি-রহস্য
মবিন সাহেব বাগানের ফুল গাছে পানি দিচ্ছিলেন। তাঁর সামনে জয়নাল দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরেই আছে, মাঝে মাঝে খুকখুক করে কাশছে, পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে নকশা কাটছে, মুখে কিছু বলছে না। মবিন সাহেব বললেন, কিছু বলবি নাকি রে জয়নাল? জয়নাল লজ্জিত মুখে হাসল। সে অল্পতেই লজ্জা পায়।
মবিন সাহেব বললেন, আজ কাজকর্ম নেই?
জে না।
জয়নালের বয়স চল্লিশের ওপরে। বিয়ে-টিয়ে করেনি। একা মানুষ। এক কামারের দোকানে কাজ করে। হাপর চালায়, কয়লায় ফুঁ দেয়। রাতে ঐ দোকামের একপাশে চট বিছিয়ে ঘুমিয়ে থাকে।
মবিন সাহেব বছরখানিক আগে কামারের দোকানে একটা শাবল বানাতে দিয়েছিলেন। জয়নাল তাকে বসিয়ে রেখে শাবল বানিয়ে নিল। নামমাত্র দাম দিল। সেই সূত্রে পরিচয়। মবিন সাহেবের মনে হয়েছে জয়নাল অতি ভদ্র, অতি সজ্জন একজন মানুষ। একটু বোধহয় বোকা। তাতে কিছু যায়-আসে না। চালাক বদলোকের চেয়ে বোকা সজ্জন ভালো। সে ছুটিছাঁটার দিনে মবিন সাহেবের বাড়িতে আসে। কিছু বলে না, মাথা নিচু করে মেঝেতে চুপচাপ করে থাকে। মবিন সাহেব তাঁর নাতনিদের সঙ্গে গল্প-গুজব করেন, সে গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনে। আজও বোধহয় গল্প শোনার লোভেই এসেছে। মবিন সাহেব গাছের গোড়ায় পানি ঢালতে ঢালতে বললেন, কি রে জয়নাল, কিছু বলবি?