স্যার দেখুন আমি ভাসছি।
হেড স্যার জবাব দিতে পারছেন না। প্রথম কয়েক মুহূর্ত মনে হচ্ছিল চোখের ভুল। এখন তা মনে হচ্ছে না। ফকফকা চাঁদের আলো। দিনের আলোর মতো সব দেখা যাচ্ছে। তিনি পরিষ্কার দেখছেন— অমর বাবু শূন্যে : ভাসছেন। এই তো ভাসতে ভাসতে খানিকটা এগিয়ে এলেন। সাঁতার কাটার মতো অবস্থায় মানুষটা শুয়ে আছে। কী আশ্চর্য!
স্যার দেখতে পাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
আজ হঠাৎ করে শূন্যে উঠে গেলাম। বন থেকে বের হয়ে রূপেশ্বরের দিকে আসছি হঠাৎ শরীরটা হালকা হয়ে গেল। দেখতে-দেখতে দশ-বারো ফুট উঠে গেলাম। প্রথমেই ভাবলাম আপনাকে দেখিয়ে আসি। ভাসতে ভাসতে আসলাম।
আর কেউ দেখেনি?
না। কয়েকটা কুকুর দেখেছে। ওরা ভয় পেয়ে খুব চিৎকার করছিল। এরকম দেখে তো অভ্যাস নেই। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে স্যার?
হ্যাঁ, হচ্ছে।
আমি ঠিক করেছি— ভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাব।
ও আচ্ছা।
আমার মাথাটা বোধহয় খারাপ হয়ে গিয়েছিল— সারাক্ষণ ব্যথা করত। এখন ব্যথাও নেই। আগে কাউকে চিনতে পারতাম না। এখন পারছি।
শুনে ভালো লাগছে অমর বাবু।
অন্য একটা কারণেও মনে খুব শান্তি পাচ্ছি। কারণটা বলি–মহাশূন্যে ভাসার রহস্যটাও ধরতে পেরেছি।
হেড মাস্টার সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, রহস্যটা কী?
রহস্যটা খুব সাধারণ। এতদিন কেন ধরতে পারিনি কে জানে। তবে স্যার আপনাকে রহস্যটা বলব না। বললে আপনি শিখে যাবেন। তখন দেখা যাবে সবাই শূন্যে ভাসছে। এটা ঠিক না। প্রকৃতি-চায় না। স্যার যাই?
অমর বাবু উপরে উঠতে লাগলেন। অনেক অনেক উঁচুতে। একসময় তাকে কালো বিন্দুর মতো দেখাতে লাগল।
হেড স্যারের স্ত্রী হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে ভীত গলায় বললেন, কী ব্যাপার? পাগলটা কোথায়?
চলে গেছে।
তুমি বাইরে কেন? ভেতরে এসে ঘুমাও।
তিনি ঘরে এঙ্গে শুয়ে পড়লেন।
.
অমর বাবুকে এর পর আর কেউ এই অঞ্চলে দেখেনি। হেড স্যার সেই রাতের কথা কাউকেই বলেননি। কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। সবাই পাগল ভাববে। আর একবার পাগল ভাবতে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত পাগল হতেই হয়–এটা তো তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন।
নীল হাতী
নীলুর যে মামা আমেরিকা থাকেন তাকে সে কখনও দেখেনি। নীলুর জন্মের আগেই তিনি চলে গিয়েছিলেন। আর ফেরেননি। নীলুর এই মামার কথা বাসার সবাই বলাবলি করে। মা প্রায়ই বলেন, আহ সঞ্জুটা একবার যদি দেশে আসত।
কিন্তু নীলুর সেই মামা নাকি আর দেশে ফিরবেন না। কোনো দিন না। একবার নানিজানের খুব অসুখ হলো। টেলিগ্রাম করা হলো সঞ্জু মামাকে। সবাই ভাবল এবার বুঝি আসবে। তাও এলো না। নীলুর বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, মেমসাহেব বিয়ে করে ফেলেছে এখন কি আর আসবে?
নীলুর খুব ইচ্ছে করে সেই মামাকে আর তার মেমসাহেব বৌকে দেখতে। কিন্তু তার ইচ্ছে হলেই তো হবে না। মামা তো আর ফিরবেই না দেশে। কাজেই অনেক ভেবেটেবে নীলু এক কাণ্ড করল। চিঠি লিখে ফেলল মামাকে। চিঠিতে বড় বড় করে লিখল–
মামা,
আপনি কেমন আছেন? আমার নাম নীলু। আপনাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। আর মেমসাহেব মামীকে দেখতে ইচ্ছে করে।
ইতি–
নীলু।
সেই চিঠির উল্টোপিঠে সে আঁকল পাখি আর সূর্যের ছবি। আর আঁকল মস্ত বড় নদী। সেই নদীতে পাল তুলে নৌকা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ভারি সুন্দর হলো ছবিটা! নীলু ভাবল, এইবার মামা নিশ্চয়ই আসবে।
মামা কিন্তু এলো না। একদিন দুদিন হয়ে গেল, তবু না। মামা চিঠির জবাবও পর্যন্ত দিল না। অপেক্ষা করতে করতে নীলু ভুলেই গেল যে, সে মামাকে চিঠি লিখেছিল। তারপরই এক কাণ্ড।
সেদিন নীলুর খুব দাঁতব্যথা সে স্কুলে যায়নি। গলায় মাফলার জড়িয়ে একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। টিপ টপ করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। এমন সময় ভিজতে ভিজতে পিয়ন এসে হাজির।
এই বাড়িতে নীলু নামে কেউ থাকে?
নীলু আশ্চর্য হয়ে বলল–
হ্যাঁ। আমার নাম নীলু।
পিয়নটি গম্ভীর হয়ে বলল, নীচে নেমে এস খুকী। তোমার জন্যে আমেরিকা থেকে কে একজন একটা উপহার পাঠিয়েছে। নাম সই করে নিয়ে যাও। নাম লিখতে পারো খুকী?
হ্যাঁ। পারি।
নীলু উপহারের প্যাকেটটি খুব সাবধানে খুলল। পিয়ন তখনও যায়নি, পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। প্যাকেটের ভেতর থেকে বেরুল নীল রঙের একটা হাতী। গলায় রুপোর ঘণ্টা বাজছে, টুন টুন করে। হাতীর শুড় আপনা থেকেই দুলছে। মাঝে মাঝে আবার কান নাড়াচ্ছে।
এত সুন্দর হাতী নীলু এর আগে আর কখনও দেখেনি। শুধু নীলু নয়, তার আব্বাও এত সুন্দর হাতী দেখেনি। অফিস থেকে ফিরেই তিনি দেখলেন তার টেবিলে নীল হাতী শুড় দোলাচ্ছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আরে, কে আনল এটা বড় সুন্দর তো!
নীলু বলল, সঞ্জু মামা পাঠিয়েছেন। দেখেন আব্বা আপনা-আপনি ঘণ্টা বাজে।
তাই তো তাই তো!
নীলুর মা নিজেও এত সুন্দর হাতী দেখেননি। তিনি কতবার যে বললেন চাবি ছাড়াই শুড় দোলায় কী করে? ভারি অদ্ভুত তো? নিশ্চয়ই খুব দামি জিনিস।
সন্ধ্যাবেলা নীলুর স্যার এলেন পড়াতে। মা বললেন–পড়তে যাও নীলু আর হাতী শোকেসে তালাবদ্ধ করে রাখো। নয় তো আবার ভেঙে ফেলবে।
মার যে কথা, এত সুন্দর জিনিস বুঝি শোকেসে তুলে রাখবে? হাতী থাকবে তার নিজের কাছে। রাতে নীলুর পাশের বালিশে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে। অনেক রাতে যদি তার ঘুম ভাঙে, তাহলে সে খেলবে হাতীর সঙ্গে।