অতসীকে ধমকে ঘর থেকে বের করে দিলেও সে গেল না। বারান্দায় পঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। তিনি বাইরে এসে বিরক্ত গলায় বললেন, কাঁদছিস কেন?
সে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল, তোমার শরীর খারাপ বাবা। তুমি বাড়িতে চল।
শরীর খারাপ তোকে কে বলল?
সবাই বলাবলি করছে। তুমি না-কি কি সব স্বপ্ন-টপ্ন দেখ।
কোনো স্বপ্ন দেখি না। আমি ভালো আছি। নির্জনে একটা পরীক্ষা করছি। পরীক্ষা শেষ হোক— তোদের সঙ্গে এসে কয়েক দিন থাকব।
কীসের পরীক্ষা।
কীসের পরীক্ষা বললে তো তুই বুঝবি না। হা করে তাকিয়ে থাকবি। এত করে বললাম সায়েন্স পড়তে।
অঙ্ক পারি না যে।
অঙ্ক না পারার কী আছে! যোগ, বিয়েগ, গুণ, ভাগ— অঙ্ক তো এর বাইরে না। কাঁদিস না। বাসায় যা। আমি ভালো আছি।
তিনি যে ভালো আছেন তা কিন্তু না।
রোজ রাতে একই ব্যাপার ঘটছে। খেয়ে-দেয়ে ঘুমুতে যান— মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে দেখেন শূন্যে ভাসছেন। তখন আতঙ্কে অস্থির হওয়া ছাড়া পথ থাকে না। তিনি ইচ্ছে করলেই নিচে নামতে পারেন না।
নিচে কীভাবে নামেন তাও জানেন না। রাতটা তার অঘুমেই কাটে। তিনি ঘুমুতে যান দিনে। এমন যদি হত তিনি দিনরাত সারাক্ষণই শূন্যে ভাসছেন তাহলেও একটা কথা ছিল। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন যে, কোনো-এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় তাঁর ভর শূন্য হয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে রকম না। এমন কেউ এখানে নেই যে তিনি সাহায্যের জন্যে তাঁর কাছে যাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যান সাহেবও কিছু লিখছেন না। হয়তো ভেবেছেন পাগলের চিঠি। কে আর কষ্ট করে পাগলের চিঠির জবাব দেয়?
ন দিনের মাথায় অমর বাবু চিঠির জবাব পেলেন। অতি ভদ্র চিঠি। চেয়ারম্যান সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডে লিখেছেন—
জনাব,
আপনার চিঠি কৌতূহল নিয়ে পড়লাম। আপনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। কাজেই বুঝতে পারছেন আপনি যে বিষয়ের অবতারণা করেছেন ঐ বিজ্ঞান স্বীকার করে না। আপনি যদি আমার অফিসে এসে শূন্যে ভাসতে থাকেন তাহলেও আমি বিশ্বাস করব না। ভাবব এর পেছনে ম্যাজিকের কোনো কৌশল কাজ করছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন জাদুকররা শূন্যে ভাসার খেলা সব সময়ই দেখায়।
যাই হোক, আপনার চিঠি পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে আপনার সমস্যাটি মানসিক। আপনি মনে-মনে ভাবছেন— শূন্যে ভাসছেন। আসলে ভাসছেন না। সবচেয়ে ভালো হয় যদি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। একমাত্র তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি আপনাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে শেষ করছি।
বিনীত
এস. আলি
M.Sc. Ph.D., F.R.S.
অমর বাবু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবার ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দিলেন না। কারণ, তিনি জানেন বিষয়টা সত্যি। তিনি দু-একটা ছোটখাট পরীক্ষা করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। যেমন স্কুল থেকে লাল রঙের চক নিয়ে এসেছিলেন। শূন্যে উঠে যাবার পর সেই লাল রঙের চক দিয়ে ছাদে বড় বড় করে লিখলেন,
হে পরম পিতা ঈশ্বর, তুমি আমাকে দয়া কর।
তোমার অপার রহস্যের খানিকটা আমাকে দেখতে দাও।
আমি অন্ধ, তুমি আমাকে পথ দেখাও।
জ্ঞানের আলো আমার হৃদয়ে প্রজ্বলিত কর।
পথ দেখাও পরম পিতা।
আরো অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল, চক ফুরিয়ে যাওয়ায় লেখা হলো না। এই লেখাটা ছাদে আছে। তিনি তাকালেই দেখতে পান। এমন যদি হতো লেখাটা তিনি একা দেখতে পাচ্ছেন তাহলেও বোঝা যেত সমস্যাটা মনে। কিন্তু তা তো না। অন্যরাও লেখা পড়তে পারছে। গত কাল বিকেলে হেড মাস্টার সাহেব তাঁকে দেখতে এসে হঠাৎ করেই বিস্মিত গলায় বললেন, ছাদে এইসব কী লেখা?
অমর বাবু নিচু গলায় বলেন, প্রার্থনা সংগীত।
প্রার্থনা সংগীত ছাদে লিখলেন কেন?
শুয়ে শুয়ে যাতে পড়তে পারি এইজন্যে।
লিখলেন কীভাবে? মই দিয়ে উঠেছিলেন না-কি?
অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেড মাস্টার সাহেব জবাবের জন্যে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, আপনার ছুটি তো শেষ হয়ে গেল, আপনি কি ছুটি আরো বাড়াতে চান?
জ্বি-না।
আপনি বরং আরো কিছুদিন ছুটি নিন। শরীরটা এখনো সেরেছে বলে মনে হয় না। আপনাকে খুব দুর্বল লাগছে।
আমার শরীর যা আছে তা-ই থাকবে স্যার। আর ভালো হবে না।
এইসব কী ধরনের কথা! কোনো ডাক্তারকে কি দেখিয়েছেন?
জ্বি-না।
ডাক্তার দেখাতে হবে। ডাক্তার না দেখালে কীভাবে হবে? বিধু বাবুকে দেখান। বিধু বাবু এল.এম.এফ. হলেও ভালো ডাক্তার। যে কোনো বড় ডাক্তারের কান কেটে নিতে পারে। বিধু বাবুকে দেখানোর কথা মনে থাকবে?
জি স্যার, থাকবে।
না আপনার মনে থাকবে না। আমি বরং নিয়ে আসব। আমার ছোট মেয়েটার জ্বর। বিধু বাবুকে বাসায় আসতে বলেছি। এলে, আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।
জি-আচ্ছা।
এখন তাহলে উঠি অমর বাবু?
একটু বসুন স্যার।
হেড মাস্টার সাহেব উঠতে গিয়েও বসে পড়লেন। তিনি খানিকটা বিস্মিত, কারণ অমর বাবু একদৃষ্টিতে ছাদের লেখাগুলির দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি স্যার–যদি কিছু মনে না করেন।
বলুন কী বলবেন। মনে কড়াকড়ির কী আছে?
অমর বাবু প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আমি শুন্যে ভাসতে পারি।
বুঝতে পারলাম না কী বলছেন।