ঘুম ভাঙলো ভোরবেলা।
অনেক বেলা হয়েছে। ঘরে রোদ ঢুকেছে। তিনি পড়ে আছেন মেঝেতে। কখন মাটিতে নেমে এসেছেন তিনি জানেন না। গায়ে কোনো ব্যথ্যা বোধ নেই, কাজেই ধপ করে পড়েন নি— আস্তে-আস্তে নেমে এসেছেন।
অমর বাবু স্বাভাবিক মানুষের মতো হাত-মুখ ধুলেন। মুড়ি গুড় দিয়ে সকালের নাশতা সারলেন। পুকুর থেকে গোসল শেষ করে যথাসময়ে স্কুলে গেলেন। আজ প্রথম পিরিয়ডেই তার ক্লাস। তিনি ক্লাস না নিয়ে নিজের চেয়ারে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। মনে হলো ঘুমুচ্ছেন। আসলে ঘুমুচ্ছিলেন না, ভাবার চেষ্টা করেছিলেন–তার জীবনে এসব কী ঘটছে?
ব্যাপারটা শুধু রাতেই ঘটছে। দিনে ঘটছে না। আচ্ছা তিনি যদি তার নিজের ঘরে না ঘুমিয়ে অন্য কোথাও থাকেন তাহলেও কি এই ব্যাপার ঘটবে? রাতে খোলা মাঠে যদি ঘুমিয়ে থাকনে তাহলে কি ভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে চলে যাবেন? মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি বা সূর্যের কাছাকাছি? কিংবা আরো দূরে এন্ড্রোমিড়া নক্ষত্রপুঞ্জে… সুদূর কোনো ছায়াপথে…?
স্যার।
অমর বাবু চমকে তাকালেন। দপ্তরি কালিপদ দাঁড়িয়ে আছে।
হেড স্যার আপনারে বুলায়।
হেড স্যার তাকে কেন ডেকে পাঠালেন তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। ইদরিস সাহেব কি হেড স্যারকে কিছু বলেছেন? বলতেও পারেন। পেট পাতলা মানুষ। বলাটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা ব্যাপারটা কি তিনি নিজে গুছিয়ে হেড স্যারকে বলবেন? বলা যেতে পারে। মানুষ ভালো। শুরুতেই অবিশ্বাসের হাসি হাসবেন না।
হেড স্যার বললেন, কেমন আছেন অমর বাবু?
জি ভালো।
দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে না। বসুন। চা খাবেন?
চা তোর স্যার আমি খাই না।
এক-আধবার খেলে কিছু হয় না। খান। কালিপদকে চা দিতে বলেছি।
কালিপদ চা দিয়ে থার্ড পিরিয়ডের ঘণ্টা দিতে গেল। হেড স্যার বললেন, শুনলাম গত কাল ক্লাস নেননি। আজও ফাস্ট পিরিয়ড মিস গেছে।
ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে স্যার।
ও আচ্ছা। আপনার তো সব ঘড়ি-ধরা। ঘুম ভাঙতে দেরি হলো কেন?
অমর বাবু চুপ করে রইলেন।
পারিবারিক কোনো সমস্যা যাচ্ছে না-কি?
জি-না।
আপনার মেয়ে গত কাল আমার কাছে এসেছিল। খুব কান্নাকাটি করল। আপনি বাড়িতে থাকেন না। এই নিয়ে বেচারির মনে খুব দুঃখ। দুঃখ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমি একা থাকতেই পছন্দ করি।
নিজের পছন্দকে সব সময় খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নেই। অন্যদের কথাও ভাবতে হয়। আমরা সামাজিক জীব…
স্যার উঠি?
বসুন খানিকক্ষণ। গল্প করি— অমর বাবু আমি বলি কি যদি অসুবিধা না থাকে তা হলে, আপনার সমস্যাটা আমাকে বলুন। ইদরিস সাহেব স্বপ্নের কথা কি সব বলছিলেন—
অমর বাবু ইতস্তত করে বললেন, বিজ্ঞানের সূত্র মিলছে না স্যার।
হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন সূত্র মিলছে না?
স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র–মধ্যাকর্ষণ সূত্র।
আপনার ধারণা সূত্রটা ভুল?
অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। একসময় বললেন, আচ্ছা আপনি বরং বাড়িতে চলে যান। আপনাকে দশ দিনের ছুটি দিয়ে দিলাম। বিশ্রাম করুন। বিশ্রাম দরকার। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মাঝে মাঝে মানুষের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়।
স্যার, আমার মাথা ঠিকই আছে।
অবশ্যই ঠিক আছে। কথার কথা বললাম। যান, বাসায় চলে যান… বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে আছে।
অমর বাবু বাড়ি গেলেন না। কমন রুমে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। হাতে একটা ফুল স্ক্যাপ কাগজ। সেই কাগজে নিউটনের সূত্র নতুনভাবে লিখলেন—
F = k.[(m1m2)/r^2]
এখানে k-এর মান ১ তবে মাঝে মাঝে ‘k’ এর মান হচ্ছে শূন্য। যেমন তার ক্ষেত্রে হচ্ছে। একসময় কলম দিয়ে নির্মমভাবে সব কেটেও ফেললেন। নিউটন যে সূত্র দিয়ে গেছেন–তার মতো সামান্য মানুষ সেই সূত্র পাল্টাতে পারেন না।
অমর বাবু টিফিন পিরিয়ডে অনেক সময় নিয়ে ইংরেজিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠির বাংলা অনুবাদ অনেকটা এই রকম—
জনাব,
আমি রূপেশ্বর হাইস্কুলের বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক। নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া আপনাকে পত্র দিতেছি। সম্প্রতি আমার জীবনে এমন এক ঘটনা ঘটিতেছে যাহার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি খুঁজিয়া না পাইয়া আপনার দ্বারস্থ হইলাম। আমি শূন্যে ভাসিতে পারি। আপনার নিকট খুব অদ্ভুত মনে হইলেও ইহা সত্য। আমি ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়া বলিতেছি–আপনাকে যাহা বলিলাম সবই সত্য। কোনো রকম চেষ্টা ছাড়াই আমি শুন্যে উঠিতে পারি এবং ভাসমান অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাইতে পারি। জনাব, বিষয়টি কী, বুঝিবার ব্যাপারে আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন তাহা হইলে এই অধম আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিবে। আপনি বলিলেই ঢাকায় আসিয়া আমি আপনাকে শূন্যে ভাসার ব্যাপারটি চাক্ষুষ দেখাইব। জনাব, আপনি আমার প্রতি দয়া করুন— বিষয়টি বুঝিতে আমাকে সাহায্য করুন।
বিনীত
অমর দাস পাল
B.Sc. (Hons)
দশ দিনের পুরোটাই তিনি নিজের ঘরে কাটালেন— বাড়িতে গেলেন না। তাঁকে নিতে তাঁর ছোট মেয়ে অতসী এসেছিল। তাকে ধমকে বিদায় করলেন। এই মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো ছিল– তাকে এত করে বললেন সায়েন্স পড়তে, সে ভর্তি হল আর্টস-এ। কোনো মানে হয়? তাকে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র কী জিজ্ঞেস করলে সে হা করে তাকিয়ে থাকবে। কী দুঃখের কথা!